ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নোয়াখালীতে একখণ্ড জাপান

বিশেষ প্রতিনিধি
🕐 ৬:০৭ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৬, ২০২২

নোয়াখালীতে একখণ্ড জাপান

দক্ষিণের জেলা নোয়াখালী কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, টিটিসিতে সেখানকার জাপানিজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ছয় মাসের কোর্স শেষ করে অনেকেই পৌঁছাতে পেরেছেন শিল্পোন্নত, নিয়ম-শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য সুপরিচিত জাপানে। তাতে নিজেরা স্বাবলম্বী, পরিবারের আর্থিক সংকট কাটিয়েছেন, দেশের জন্য আনছেন মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। ২০১৮ সালে জাপানিজ ভাষার এই কেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর প্রথমে তেমন সাড়া না পাওয়া গেলেও এখন স্বপ্নের দেশটিতে গমনে অবদান রাখছে জাপানিজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি।

টিটিসি প্রাঙ্গণে কখনো শারীরিক কসরৎ, কখনো ক্লাসে আলাপচারিতা হচ্ছে জাপানিজ ভাষায়। টিটিসির এই ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রটি যেন হয়ে উঠেছে একখণ্ড জাপান। আর যাকে ঘিরে, যে মানুষটিকে কেন্দ্র করে সাফল্য আসতে শুরু করেছে- তিনি আমিনা নিতু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানিজ স্টাডিজ থেকে মাস্টার্স করে এই প্রকল্পে যোগ দিয়ে ২০১৯ সাল থেকে লেগে আছেন জাপানিজ ভাষা নিয়ে। স্বযত্নে ছেলেদের শেখাচ্ছেন কঠিন ভাষাটি। এরই মধ্যে তার কাছ থেকে ভাষার প্রাথমিক দক্ষতা অর্জন করে ৩৫ জন চলে গেছেন তাদের স্বপ্নের গন্তব্যে, আরো অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আছেন জাপান যাওয়ার প্রক্রিয়ায়।

জাপানিজ ভাষা প্রশিক্ষণ নিয়ে সরকারিভাবে বিনা খরচে জাপান যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন ছাত্ররা। ইন্টারন্যাশনাল ম্যানপাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন, জাপানি সহায়তায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটিকে সংক্ষেপে বলা হয় আইএমজাপান। এই আইএমজাপান-এর সহায়তায় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটির মাধ্যমে সরকারিভাবে জাপান যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে। নোয়াখালী কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষক আমিনা নিতু শিক্ষার্থীদের সাফল্যের মধ্যমনি।

খোলা কাগজকে জাপানিজ ভাষার প্রশিক্ষক আমিনা নিতু বলেন, জাপান যাওয়ার টেকনিকাল দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি তারা দেশ ও জাতিকে কারিগরি সহায়তা করতে পারবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে। ফেব্রুয়ারি ২০২৩ থেকে স্পেসিফিক স্কিলড ওয়ার্কার বা এসএসডব্লিউ ভিসা বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো চালু হবে। আমাদের সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রশিক্ষণার্থী সুযোগ পায় সেই লক্ষ্যে কাজ করছি। সেই মোতাবেক পরিকল্পনা সাজিয়েছি।


নূর মোহাম্মদ রিমন একাউন্টিংয়ে অনার্স করেছেন। চার ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই একটি ব্যাংকে কর্মরত, ছোট দুই ভাই পড়াশোনা করছেন। নোয়াখালী টিটিসিতে জাপানিজ ভাষা শিখছেন। লক্ষ্য একটাই, স্বপ্নের দেশ জাপান যাওয়া। রিমন বলেন, ভাষা শেখার শুরুতে খুব কঠিন লেগেছে। কিন্তু আমিনা নিতু ম্যাম কীভাবে যেন আগ্রহ জাগিয়ে ফেললেন একদম অপরিচিত ভাষাটির প্রতি। উনার যত্নে এবং নির্দেশনায় এখন ভাষাটা অনেকটাই আয়ত্বে আসছে।


বর্তমানে অধ্যয়নরত ছাত্র হাবিবুর রহমান বলেন, আমি টিটিসিতে ভাষা শিখছি, এখানে খুব যত্নসহকারে ভাষা শেখানো হয়। আমাদের আমিনা নিতু ম্যাম খুব আন্তরিক। তিনি খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের শেখান, হাতে-কলমে তিনি আমাদের বুঝিয়ে দেন। সব ছাত্রের মেধা সমান থাকে না। তিনি দুর্বলদের আলাদা সময় দিয়ে এগিয়ে দেন।

ছয় মাসের কোর্স শেষ করে জাপান যাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন নোয়াখালী টিটিসির সাবেক ছাত্র মোহাম্মদ ইমরান। ছয় মাসের কোর্সে সাফল্যের পর ঢাকার মানিকগঞ্জে আইএমজাপানের তত্ত্বাবধানে আরো চার মাসের প্রশিক্ষণ চলে। এরই মধ্যে কৃষি নিয়ে পড়াশোনা করা ইমরানের উপ-সহকারী কর্মকর্তা পদে সরকারি চাকরি হয়েছে। এখন তিনি দোটানায় আছেন, তিনি জাপান যাবেন নাকি সরকারি চাকরি করবেন। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, আমি যদি সরকারি চাকরিতে যোগও দিই, তারপরও কৃষি বিষয়ে উচ্চতর একটা প্রশিক্ষণ নিয়ে জাপান যাবই। হয় শিক্ষা ছুটি নিব, নয়তো চাকরি ছেড়েই যাব।

ইমরান বলেন, আমার সাফল্যের পেছনে অবদান নোয়াখালী টিটিসি আর আমিনা নিতু ম্যাম। উনিই আমাকে জাপানিজ ভাষার প্রথম পাঠ দিয়েছেন।

বর্তমানে জাপানে অবস্থান করছেন নোয়াখালী টিটিসির ছাত্র আল আমিন। তিনি নোয়াখালীর এই কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে সরকারিভাবে ২০১৯ সালে জাপান যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। আল আমিন বলেন, আমার জীবন বদলে গেছে, আমার পরিবার অর্থনৈতিক অবস্থা বদলে গেছে। আমি আজীবন কৃতজ্ঞ।

২০১৮ সালে নোয়াখালী টিটিসির যাত্রা শুরুর পর এ পর্যন্ত ২২২ জন কোর্সে ভর্তি হন, তার মধ্যে সাফল্যের সঙ্গে কোর্স শেষ করেন ১২৫ জন।

নোয়াখালী টিটিসির অধ্যক্ষ মাহতাব উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, আমরা প্রশিক্ষণের গুণগত মানে কোনো ছাড় দেয় না। জাপানি ভাষার সঙ্গে আমরা টিটিসির ১৪টি ট্রেডের যেকোনো একটিতে দক্ষ করে তাদের জাপান যাওয়ার পথ সুগম করি। প্রশিক্ষক আমিনা নিতু যেমন কঠোর পরিশ্রম করেন জাপানিজ ভাষায় শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তুলতে, আমরাও আবার সব কিছু মনিটরিং করি।

প্রসঙ্গত, যারা জাপান যেতে চান তাদের জাপান সরকার পরিচালিত দুটি পরীক্ষায় দক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। জিএলপিটি নামের প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষাটি এন-৫ ও মাধ্যমিক পর্যায়ের এন-৪ পরীক্ষায় জাপানি ভাষায় দক্ষতা মূল্যায়ন হয়। প্রার্থীর বয়স ১৮ হতে ২৮ বছর এবং নিম্নতম শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক হতে হয়। উচ্চতা কমপক্ষে ১৬০ সে. মি হতে হবে।
ইতোপূর্বে যারা জাপানে কর্মরত ছিলেন তারা আবেদন করতে পারবেন না।

ফর্মসমূহ যাচাই-বাছাই করার পর যোগ্যপ্রার্থীদের প্রাথমিকভাবে বাছাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য প্রার্থীগণকে নির্ধারিত সময় ও তারিখে বিএমইটি কর্তৃক মনোনীত কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কাগজপত্রাদিসহ উপস্থিত থাকতে হয়। কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে জাপানি ভাষায় পর্যাপ্ত দক্ষতা সংক্রান্ত মূল সনদসহ এক সেট ফটোকপি। এইচএসসির মূল সনদপত্রসহ এক সেট ফটোকপি। সদ্য তোলা দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি। মূল জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অথবা জন্ম সনদসহ ১ সেট ফটোকপি এবং জীবন বৃত্তান্ত।
কাগজপত্র যাচাই বাছাই অন্তে যথাযথ প্রমাণিত হলে আইএম জাপানের প্রতিনিধি দল কর্তৃক প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত টেকনিক্যাল ইন্টার্নদের পরবর্তীতে গণিত ও জাপানি বর্ণমালা এবং শারীরিক যোগ্যতা বিষয়ক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়।

গণিত ও জাপানি বর্ণমালা এবং শারীরিক যোগ্যতা বিষয়ক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের পর্যায়ক্রমে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অধীন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৬ মাস মেয়াদী প্রি-ডিপার্চার ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণ করতে হয়। উক্ত প্রি-ডিপার্চার ট্রেনিং সফলভাবে সম্পন্নকারীগণ টেকনিক্যাল ইন্টার্ন হিসেবে প্রথমে ৩ বছরের চুক্তিতে জাপান গমন করে থাকেন। ৩ বছরের চুক্তি সফলভাবে সম্পন্নকারীগণের চাকরির মান সন্তোষজনক, কর্মক্ষেত্রে সফলতা এবং কোম্পানির চাহিদার ভিত্তিতে এ চুক্তি আরো ২ বছরের জন্য নবায়ন করা হবে। প্রি-ডিপার্চার ট্রেনিং ও থাকা বাবদ কোনো খরচ প্রার্থীগণকে বহন করতে হবে না। তবে খাওয়া বাবদ খরচ প্রার্থীগণকে বহন করতে হবে।

জাপানে টেকনিক্যাল ইন্টার্ন হিসেবে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো অভিবাসন ব্যয় কর্মীদের কাছ থেকে নেওয়া হবে না। শুধুমাত্র পাসপোর্ট তৈরি, মেডিকেল ফি এবং বহির্গমন ছাড়পত্র সংক্রান্ত ফি কর্মীদের বহন করতে হবে।

 

 
Electronic Paper