ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রতিযোগিতা নয়, চাই সমন্বয়

আরিফ আনজুম
🕐 ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৭, ২০২০

মহামারী এবং আর্থিক মন্দার ছায়া পড়েছে গোটা বিশ্বে। তাই এককভাবে কোনো দেশের উদ্যোগ প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। ভাইরাস কোনো দেশের সীমান্ত বোঝে না। ধনী দেশ মানেই সেখানে সংক্রমণ হবে না, এমন ধারণাটা ক্রমশ ফিকে হচ্ছে। চারদিকে যখন ঘোর অনিশ্চয়তা কিন্তু দুটো ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। প্রথমত, যত দ্রুত সম্ভব আমরা কোভিড মহামারীর শেষ দেখতে চাই। দ্বিতীয়ত, যত বেশি সম্ভব প্রাণ আমরা বাঁচাতে চাই। সেই লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা প্রতিষেধক তৈরির দৌড়ে শামিল হয়েছেন।

কিছু দেশ অবশ্য গবেষণা শেষ হওয়ার আগেই প্রতিষেধক কেনার চুক্তি করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু গবেষণা ক্ষেত্রে যদি সমন্বয় না করে আমরা এগোই, তাহলে মহামারী নিকট ভবিষ্যতে শেষ তো হবেই না, বরং আরও ভয়ঙ্কর চেহারা নেবে। গেটস ফাউন্ডেশন থেকে নর্থ-ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মোবস ল্যাবের মডেলারদের দুটি পৃথক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। প্রথম পরিস্থিতি হলো উচ্চ আয়ে ৫০টি দেশ প্রতিষেধকের প্রথম ২০০ কোটি ডোজ করায়ত্ত করেছে। দ্বিতীয়টি হলো, সারা বিশ্বের প্রতিষেধক যেন সমানভাবে বণ্টন হয়, যা কোনো দেশের সম্পদের ওপর নির্ভরশীল থাকবে না। মোবস ল্যাব বহু বছর ধরে বিশ্বে ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ ছড়ানোর মডেল তৈরি করে আসছে। কোভিড ভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে তাই ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষেত্রে এ ল্যাবের জুড়ি মেলা ভার। তবে এবারের চ্যালেঞ্জটা অন্যরকম।

সংক্রমণ কোন দিকে মোড় নেবে, সেই বিষয়ে অজানা ফ্যাক্টর আছে একাধিক। সংক্রমণ নতুন বলে পুরনো তথ্য হাতড়ে কিছু খুঁজে পাওয়ার সুয়োগ নেই। তাই মোবস ল্যাব বিভিন্ন কাউন্টার ফ্যাকচুয়াল পরিস্থিতি তৈরি করে দেখার চেষ্টা করেছে, ২০২০ সালের মার্চের মাঝামাঝি প্রতিষেধক বাজারে এলে কী হতে পারত। যেহেতু বাস্তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর কোনো প্রতিষেধক নেই, তাই এই গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু বিষয় আগাম অনুমান করে তার ওপর ভিত্তি করে এগোতে হয়েছিল। যেমন, একটি অনুমান হলো, প্রতিষেধকের একটি ডোজ প্রয়োগের পর তা ৮০ শতাংশ কার্যকরী থাকবে। দ্বিতীয়টি, প্রতি সপ্তাহে সাড়ে ১২ কোটি ডোজ দেওয়া যাবে। তবে, এই গবেষণাগুলোর ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে।

যে দুটি পরিস্থিতিকে ধরে এই গবেষণা এগিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, যদি ২০২০ সালের মার্চ মাসেই প্রতিষেধক চলে আসত এবং তার বণ্টনে স্বচ্ছতা থাকত, তাহলে এ বছরের ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬১ শতাংশ মৃত্যু এড়ানো যেত। কিন্তু যদি ধনী দেশগুলোর কাছে আগে প্রতিষেধক চলে আসত, তাহলে এমন পরিস্থিতিতে দুগুণের বেশি মানুষ মারা যেত এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশে ছড়িয়ে পড়ত। চার্ট করে দেখানো হচ্ছে, প্রতিষেধক বিলির পদ্ধতি কীভাবে মৃত্যুসংখ্যা কমানোয় ভূমিকা পালন করে। নর্থ-ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, যদি মার্চ মাসের মাঝামাঝি একটি প্রতিষেধক চলে আসত, তা হলে ধনী দেশগুলোকে অগ্রাধিকার না দিয়ে জনসংখ্যার অনুপাতে তা প্রদান করা হলে প্রায় দ্বিগুণ বেশি প্রাণ বাঁচানো যেত।
কিন্তু এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন ধনী দেশের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, দ্বিতীয় পরিস্থিতিটা সৃষ্টির সম্ভাবনাই প্রবল। আমরা বুঝি, কোন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের সরকার বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে প্রতিষেধক উৎপাদনের পাকা কথা বলে রাখছে। দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়টি যেমন সরকারের, তেমনই সরকার বিনিয়োগ করলে গবেষণার ধার ও ভার বাড়ে। উৎপাদনকেন্দ্র তৈরির খরচও উঠে আসবে।

মহামারী এবং আর্থিক মন্দার ছায়া গোটা বিশে^র ওপরে পড়েছে। তাই এককভাবে কোনো দেশের উদ্যোগ এই প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। ভাইরাস কোনো দেশের সীমান্ত বোঝে না। ধনী দেশ মানেই সেখানে সংক্রমণ হবে না, এমন ধারণাটা ক্রমশ ফিকে হচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের কথা ধরা যাক। সংক্রমণটিকে তারা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছিল। দেশটায় জীবন ফিরছিল স্বাভাবিক ছন্দে, এমনকি ভরা মাঠে রাগবি খেলারও আয়োজন করা হয়েছিল। তারপরেও সে দেশের অর্থনীতি ধাক্কা খেয়েছে, করোনাও ফিরে এসেছে আর নিউজিল্যান্ডকে আবার শাটডাউনের পথে হাঁটতে হয়েছে। আমরা দুজনই সুস্বাস্থ্যের সাম্যের পক্ষে সোচ্চার। গেটস ফাউন্ডেশন এমন সব রোগের সঙ্গে লড়াই করে, যেগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। ধনী দেশগুলো সরকারের এমন সব গরিবের রোগ নিয়ে ভাবার ফুরসত নেই।

কিন্তু কোভিডের ক্ষেত্রে সমস্যাটা উল্টো। এখানে ধনী দেশগুলোই এই সংক্রমণের আঁতুড় হয়ে উঠেছে। তাই দরিদ্র দেশগুলোর সমস্যা হয়তো পেছনের সারিতে চলে যাবে। তবে এখন মানবিক দিক থেকে ভাবা এবং আত্মকেন্দ্রিক ভাবনার কোনো বিভেদ নেই। কোভিডের প্রতিষেধক বণ্টনে স্বচ্ছতা থাকলে দ্রুত এ মহামারী শেষ করা যাবে। প্রতিষেধক তৈরিতে একটা মাস বাঁচানো মানে বিশ্ব অর্থনীতির আনুমানিক ৫০ হাজার কোটি ডলারের ক্ষতি বাঁচানো। গুটিকয়েক দেশে প্রতিষেধক পৌঁছালে হয়তো তাদের অর্থনীতির হাল কিছুটা ফিরবে। কিন্তু এটা অসম্ভব, একদিকে বিশে^ মহামারী ছড়িয়ে পড়বে আর ওই দেশগুলোর অর্থনীতির শ্রীবৃদ্ধি হবে। কারণ পরিস্থিতি না ঠিক হলে সরবরাহব্যবস্থা বজায় রাখা যাবে না। আন্তর্জাতিক উড়ানও থমকে থাকবে। তাহলে কার্যকরী এবং ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপ কী রকম হওয়া উচিত? এমন একটি উদ্যোগকে সাহায্য করছে, যেখানে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিশে^র বিভিন্ন সংস্থা একত্রে রোগনির্ণয়, চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করা এবং প্রতিষেধক তৈরি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।

আরিফ আনজুম: শিবগঞ্জ সরকারি এম এইচ কলেজ, বগুড়া
[email protected]

 
Electronic Paper