ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

তপন বাগচী একজন ঘটমান বর্তমানকাল!

রেজা ঘটক
🕐 ১২:২৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৩, ২০২০

তপনদার সঙ্গে আমার পরিচয় লেখালেখির সূত্র ধরেই। নব্বইয়ের দশকে যাদের কবিতা বা প্রবন্ধ পত্রিকায় পড়তাম তপন বাগচী তাদের একজন। দাদার সঙ্গে সরাসরি পরিচয় একুশ শতকের শুরুর দিকে। সম্ভবত তপনদা তখন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে চাকরি করতেন। তপনদার ‘শ্মশানেই শুনি শঙ্খধ্বনি’ কবিতার বইটি সম্ভবত আমি প্রথম কিনেছিলাম। বইটি বুকসেলফ খুঁজে কোথাও আর পেলাম না। ঢাকা শহরে বারবার বাসা বদলের কারণে এভাবে অনেক বই হারিয়েছে।

২০০৮ সালে যখন রাজীব নূরের সঙ্গে পাঠসূত্র প্রকাশনাটি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি, তখন তপনদার সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। সে বছর তপনদার কবিতার বই ‘সকল নদীর নাম গঙ্গা ছিল’ বের হয়েছিল। ওটাও আমার সংগ্রহে ছিল। সে বছর তপনদা যখন কলকাতা সফরে গেলেন, আমরা পাঠসূত্র থেকে তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের একটি বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। তপনদা সেই শিক্ষকের কাছ থেকে অনুমতিপত্র ও অন্যান্য যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। শেষপর্যন্ত বইটি আর প্রকাশ করা হয়নি। তপনদা কলকাতা থেকে ফিরে আমার সঙ্গে সেসব অভিজ্ঞতা তখন শেয়ার করেছিলেন।

তপনদা জার্নালিজমের ছাত্র হওয়ার পরও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহের কারণে এবং বিশেষ করে লোকায়ত জনজীবন, সংগীত ও কৃষ্টির প্রতি তার আগ্রহের কারণে ধীরে ধীরে দাদার সঙ্গে আমার একটি আত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তখন থেকেই তপনদা নতুন কোনো গান লিখলে বা সেই গানে সুর করলে আমার সঙ্গে তা নিয়ে নিয়মিত আড্ডা হয়। অমর একুশে গ্রন্থমেলার পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই আমাদের প্রতিদিন আড্ডা, মতবিনিময়, বইমেলার আপডেট, নতুন বই, কোন বইটি কেনার মতো, কোন বইটি কেন আলোচিত এসব নানান প্রসঙ্গে নিয়মিত আড্ডা হয়।

লেখালেখির কোনো বিষয়ে আমার তথ্য প্রয়োজন হলে প্রায়ই তপনদার শরণাপন্ন হই। তপনদা যত ব্যস্ত থাকুক আমার সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য দাদার যথাসময়ে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারটি সবসময়ই মুগ্ধ করে। তপনদার বাড়ি পদ্মার ওপারে মাদারীপুরে আর আমার বাড়িও পদ্মার ওপারে পিরোজপুরে। পদ্মার ওপারে দুজনের বাড়ি হওয়ায় আমরা দুজনেই ঢাকায় মাইগ্রেট হওয়া মানুষ। তাই আমাদের মধ্যে একটা আঞ্চলিক টানও অনেক সময় কাজ করে হয়তো। কিন্তু তপনদা সেটা একদম বুঝতে দেন না। তপনদা যখন একুশে টেলিভিশনে কাজ করেন তখন আমাকে টেলিভিশনে কাজ করার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। কিন্তু আমি কখনো সরাসরি মিডিয়ায় চাকরি করার ব্যাপারে আগ্রহী হইনি। কারণ তপনদার কাছেই মিডিয়ার ভিতরের দৈনন্দিন ক্যু পাল্টা ক্যু’র যত গল্প শুনেছি, যে কারণে এ দলাদলিতে নিজেকে যুক্ত করার আগ্রহ পাইনি। একবার তপনদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি প্রথম আলোতে লেখা দাও না কেন?

বললাম, ওখানে আমার অনেক বন্ধু চাকরি করে। যে পাতায় আমি লিখতে চাই, সেসব পাতার দায়িত্ব পালন করে আমার বন্ধুরা। ওরা আমার লেখা না চাইলে কোনোদিন লেখা দেব না।

জবাবে দাদা বলতেন, তোমার অভিমানের জায়গাটা বুঝেছি। কিন্তু লেখালেখিতে লাইমলাইটে আসতে চাইলে বন্ধুদের সঙ্গে একটু খায়খাতির রাখবা। অভিমান দেখালে নিজেই লস করবা। পরে শুনেছি তপনদা প্রথম আলো’র সম্পাদকীয় বিভাগেও কাজ করতেন। কিন্তু কখনোই আমাকে তা বলেননি।

তপনদাকে বেকার থাকাকালীনও দেখেছি। সকার থাকাকালীনও দেখেছি। কখনো আমার আলাদা মনে হয়নি। সম্পূর্ণ নিরহংকার একজন মানুষ। তপনদার আমার সঙ্গে দেখা হওয়া মানে মিনিমাম দুইবার চা আর দুইবার সিগারেট খাওয়াবেন। আর চলতি সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে একচোট আড্ডা হবে আমাদের। তপনদা রাজধানী ঢাকায় বসবাস করলেও আসলে অন্তরে তিনি একজন বাউল মানুষ। সেই বাউল তপনদাকেই আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। কেয়া বৌদি সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করায় তপনদা হয়তো তার বাউলগিরি করার সুযোগ একটু বেশি পাচ্ছেন। সংসারের গোটা দায়িত্ব সামলানোর তো একজন আছে। অমর একুশের কোনো এক বইমেলায় কেয়া বৌদি’র সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন দাদা নিজেই। সঙ্গে দাদার বড় মেয়ে তূণীর ছিল। সে বছর তপনদার ছোটদের জন্য একটা ছড়ার বই বের হয়েছিল ‘স্বপ্নেবোনা তূণীর সোনা’ নামে। আমার বন্ধু কথাসাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধা আর আমি বাংলা একাডেমির বইমেলায় আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ তপনদা ফুল ফ্যামিলি নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। তারপর কেয়া বৌদি ও তূণীরসহ আমরা সবাই একযোগে ‘স্বপ্নেবোনা তূণীর সোনা’ বইটি দেখতে গেলাম। প্রতিবছরের অমর একুশে বইমেলায় আমাদের এমন টুকটাক অনেক স্মৃতি আছে। তপনদার সবচেয়ে বড় গুণ হলো আমার কোনো লেখার বিষয়ে যদি তথ্য সংকট থাকে বা আমার সেই বিষয়ে ধারণা একটু কম থাকে, একেবারে শিক্ষকের মতো আড্ডার ছলে বুঝিয়ে দেন। আরও তথ্য লাগলে নিজে সময় বের করে তখন তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন।

ঢাকার সাহিত্যাঙ্গনে বড়দের মধ্যে যাদের দু-একজনের সঙ্গে আমার ‘তুমি’ সম্বোধনের সম্পর্ক, তপনদা সেই নিবিড় গোষ্ঠীর একজন। তপনদাকে আমি ‘তুমি’ সম্বোধন করি। দাদাও আমাকে তুমি বলেন। আর কোনো বিষয়ে দাদার মেজাজ খারাপ থাকলে তখন তুই বলেন। তপনদা এখন যেমন গান নিয়ে খুব ব্যস্ত। একেক সময় তপনদার একেকটা বিষয়ের প্রতি খুব ঝোঁক দেখেছি। একবার দাদার সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা। জিজ্ঞেস করলাম, তোমারে একদম দেখি না ক্যান? শাহবাগ ওঠো না বুঝি? জবাবে দাদা বললেন, আর কইও না। গোপালগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতেছি। এজন্য প্রায়ই গোপালগঞ্জ ছুটতে হচ্ছে। এর বাইরে আমার অন্যান্য নিয়মিত শিডিউলগুলো তো আছেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে লেখা না হলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ভুল তথ্য যাবে। ‘মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ’-এর ইতিহাস লেখার সময় তপনদার সেই পরিশ্রম ও একনিষ্ঠতা আমাকে সত্যি তখন খুব মুগ্ধ করেছিল। এখনো তপনদার প্রতি আমার সেই মুগ্ধতা কাজ করে যখন দেখি দাদা একটা গানের সঠিক ইতিহাস তুলে আনার জন্য সেই গ্রামে ছুটে যান।

বাংলা একাডেমিতে যোগ দেওয়ার পর দাদার ব্যস্ততা আগের চেয়ে বেড়েছে। একাডেমির ফোকলোর বিভাগে কাজ করার বাইরে নিজের গবেষণাকর্ম দাদা এখনো অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন। তার মধ্যে যখনই দেখা হয়, আমরা আগের আড্ডা থেকে মাঝখানের দিনগুলো পরম্পরা আপডেট করি। সেদিন দাদার সদ্য লেখা একটা গান নিয়ে আমরা শাহবাগ আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ তূণীর ফোন- বাবা, বাসায় ফেরার পথে অঙ্কন খাতা নিয়ে এসো। মেয়ের জন্য খাতা কিনে বাসায় ফিরতে হবে। কিন্তু দাদার আমার সঙ্গে আড্ডা আর শেষ হয় না। একসময় বললেন, আজ যাই রে, নইলে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে মেয়ের খাতা ছাড়া বাসায় ঢোকা যাবে না!

বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে যে দু’চারজন মানুষের সঙ্গে আমার নিবিড় পরিচয়, তপনদা সেই গোত্রের অন্যতম একজন। দেশের চলমান রাজনৈতিক বিভিন্ন নৈরাশ্য ও দীনতা নিয়ে লেখার জন্য তপনদা সবসময় আমাকে লেখার জন্য প্রেরণা দিয়ে থাকেন। বাংলা একাডেমিতে চাকরি করলেও একাডেমির অনেক ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তপনদাকে আমি সক্রিয় থাকতে দেখেছি। অন্য কেউ হলে চাকরি বাঁচানোর ভয়ে এসব নিয়ে টুঁ-শব্দ করতেন না। গত ৮ অক্টোবর, ২০১৬ তারিখে লেখক-শিক্ষক ও বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য রতনতনু ঘোষের লাশ শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বাংলা একডেমিতে ঢুকতে দেওয়া না হলে, একাডেমির বাইরে তখন একাডেমির ওই সিদ্ধান্তকে ঘিরে যে আন্দোলন হয়েছিল, তপনদা তখন একাডেমি থেকে বাইরে এসে আমাদের সঙ্গে ওই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। একাডেমিতে চাকরি করে একাডেমির সিদ্ধান্তের বাইরে এমন সংহতি প্রকাশের ঘটনা বাংলাদেশে আমার খুব একটা চোখে পড়েনি। তপনদা তেমন একজন নিরহংকার মানুষ। সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে কখনো হীনম্মন্যতায় ভোগেন না। তপনদার এই দৃঢ়তাকে সত্যি সত্যিই খুব স্যালুট করি।

তপনদার জন্মদিন ২৩ অক্টোবর। এ উপলক্ষে তপনদাকে নিয়ে একটা বিশেষ সংকলন প্রকাশ হওয়ার কথা শুনেছি। আমি আমার ডেব্যু সিনেমা ‘হরিবোল’ নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকায় তপনদাকে নিয়ে গুছিয়ে লিখতে পারলাম না। এ কষ্ট আমাকে ভবিষ্যতে আরও দাহ করবে। ইচ্ছা ছিল তপনদার লোকজ সাহিত্য নিয়ে লেখালেখিগুলোর ওপর একটা নিবন্ধ লেখার। কিন্তু তপনদার সেই বইগুলো সব কাছে নাই। আর নতুন করে পড়ারও সময় বের করা এখন সম্ভব না হওয়ায়, এ লেখায় কেবল স্মৃতিচারণ করলাম। তপনদার সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্কটা আজীবন টিকে থাকুক। দাদার লেখালেখি ও সৃষ্টিময় জীবন আরও দীর্ঘ হোক সেই প্রত্যাশা করি। তপন মানে সূর্য। সূর্য যেমন নিজস্ব শক্তি নিয়ে মহাশূন্যে বিচরণ করে, প্রিয় তপনদাও তেমনি নিজস্ব সৃষ্টিময় শক্তি নিয়ে আমাদের মাঝে বিচরণ করুক। এটাই প্রত্যাশা।

রেজা ঘটক : কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা

 
Electronic Paper