বঙ্গবন্ধু কন্যার ফিরে আসা
মিল্টন বিশ্বাস
🕐 ৯:৪৭ অপরাহ্ণ, মে ১৬, ২০১৯
বাংলাদেশের অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ হাসিনার ৩৯তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ১৭ মে। দিনটি স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারীরা আমাকে ৬টি বছর দেশে আসতে দেয়নি। যখন দেশে এলাম, তখন বিমানবন্দরে লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এত মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হলাম, কিন্তু আমার চোখ ঘুরে ফিরছিল পরিবারের সেই চেনা মুখগুলো খুঁজতে। কিন্তু কাউকে খুঁজে পাইনি। আমি যখন দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই, তখন দলের নেতারা আমাকে সভানেত্রীর দায়িত্ব দেন।
দেশে ফিরে অসহ্য বেদনার মধ্যেও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্ত যাতে বৃথা না যায় সেই কাজ করতে হবে। আমি সেই থেকে দেশের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করে যাচ্ছি। দেশের মানুষের উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমি কাজ করে যাচ্ছি, এ জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতেও আমি প্রস্তুত রয়েছি।’ তার এই নির্লোভ ও আত্মত্যাগী মানসিকতাই স্বাভাবিক। কারণ তিনি তো আমাদের জাতির পিতার কন্যা।
১৯৮১ সালের ১৭ মে অর্থাৎ ৩৯ বছর পূর্বের সেই দিনটি এখনকার মতো ছিল না। সেদিন ছিল ভারী বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়ার এক অপরাহ্ণ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকা- বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনার পদস্পর্শে সেই জল্লাদের দেশ পুনরায় সোনার বাংলা হয়ে ওঠার প্রত্যাশায় মুখরিত হয়েছিল। আজ তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি।
তিনি এক বৃহৎ শূন্যতার মাঝে এসে দাঁড়ালেন। এখানে তার ঘর নেই; ঘরের আপনজনও কেউ নেই। তাই সারা দেশের মানুষ তার আপন হয়ে উঠল। তিনি ফিরে আসার আগে ছয় বছর স্বৈর শাসকরা বোঝাতে চেয়েছিল তারাই জনগণের মুক্তিদাতা। কিন্তু সাধারণ মানুষ ক্ষণে ক্ষণে জেগে উঠছিল, বিচার দাবি করছিল জাতির পিতার হত্যাকা-ের। সেনা শাসকের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকায় জনগণের শাসনের দাবি নিয়ে রাজনীতির মাঠে রাতদিনের এক অক্লান্ত কর্মী হয়ে উঠলেন শেখ হাসিনা। তিনি নেতা কিন্তু তারও বেশি তিনি কর্মী। কারণ দলকে ঐক্যবদ্ধ করা, বঙ্গবন্ধু ও তার শাসনকাল সম্পর্কে অপপ্রচারের সমুচিত জবাব দেওয়া, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা তার প্রাত্যহিক কর্মে পরিণত হলো।
দেশে ফেরার প্রতিক্রিয়ায় আবেগসিক্ত বর্ণনা আছে তার নিজের লেখা গ্রন্থগুলোতে। তুলে ধরছি একটি উদ্ধৃতি : ‘আমার দুর্ভাগ্য, সব হারিয়ে আমি বাংলাদেশে ফিরেছিলাম। লক্ষ মানুষের স্নেহ-আশীর্বাদে আমি সিক্ত হই প্রতিনিয়ত। কিন্তু যাদের রেখে গিয়েছিলাম দেশ ছাড়ার সময়, আমার সেই অতি পরিচিত মুখগুলো আর দেখতে পাই না। হারানোর এক অসহ্য বেদনার ভার নিয়ে আমাকে দেশে ফিরতে হয়েছিল।’ (ড. আবদুল মতিন চৌধুরী : আমার স্মৃতিতে ভাস্বর যে নাম, বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম, পৃ. ৭৪)।
আমরা জানি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে ছাত্র জীবন থেকেই তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। ১৯৬২-তে স্কুলের ছাত্রী হয়েও আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে নেতৃত্ব দিয়ে মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষাবর্ষে কলেজ ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের পথ চলা। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ও রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক হন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহ হলেও রাজনীতির সঙ্গেই তার আজীবন বসবাস। কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন, শেখ হাসিনা যখনই বঙ্গবন্ধু’র স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন তখনই বুঝে নিয়েছিলেন- ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু পথ।’ তার ‘পথে পথে গ্রেনেড ছড়ানো’। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের (১৯৮১ সালের ১৭ মে) আগে ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে তার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, জীবনের ঝুঁকি আছে এটা জেনেও তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চের সামরিক শাসন জারির দুইদিন পর স্বাধীনতা দিবসে একমাত্র শেখ হাসিনাই সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি সামরিক শাসন মানি না, মানবো না। বাংলাদেশে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবোই করবো।’ তাই তো কবি ত্রিদিব দস্তিদার শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ’।
দুঃখী রাজকন্যার মতো হৃতরাজ্য, হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য শেখ হাসিনার জন্ম ও পুনর্জন্মের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল দেশ ও জনতার। পূর্বেই বলেছি, তার পুনর্জন্মের আগে নৈরাজ্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল মানুষ। পাকিস্তানি শাসক, দালাল-রাজাকার ও আন্তর্জাতিকভাবে কয়েকটি দেশের বাধা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং আপামর জনগণের অংশগ্রহণে ৯ মাসের মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করার প্রচেষ্টা সফল হতে দেয়নি খুনিরা। ফলে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী সামরিক শাসকদের অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে। দেশের প্রতিকূল এক সময়ে জননেত্রীকে আমরা রাজনীতির মঞ্চে পেলাম।
মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,
[email protected]