ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অর্থ পাচার নিয়ে ঢাক গুড় গুড়

জাফর আহমদ
🕐 ১০:৫৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২২, ২০১৮

গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ছয় লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। একই সময়ে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৯৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, তার ছয়গুণ বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশ থেকে টাকা পাচারের খবরের পেছনে সত্য-মিথ্যা যাই থাক না কেন, পাচার রোধে সম্প্রতি শক্ত অবস্থান নেওয়া হয়েছে। এ কারণে টাকা পাচারের সম্ভাব্য পথের অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হয়েছে। তবে ভিন্নমতও আছে অর্থনীতিবিদদের। অনেকে মনে করছেন, টাকা পাচার হওয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব ও খেলাপি সংস্কৃতি প্রধান কারণ। এটা বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।  
গত কয়েক বছরে টাকা পাচারের যে খবর বেরিয়েছে তার সবই বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে দুর্নীতি ও চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার করে সুইস ব্যাংকে রাখার খবর রয়েছে। টাকা পাচার করে দুর্নীতিবাজরা বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। নগদ অর্থ জমা রাখছে বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বিদেশিদের জন্য দেশটির সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশ থেকে বিদেশে কোনো টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। কিন্তু এ পর্যন্ত কাউকে ব্যাংক থেকে এ ধরনের কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। ফলে যারা সুইস ব্যাংকে জমা করেছে এবং কানাডা বা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছে তারা নিশ্চিত টাকা পাচার করে এ সম্পদের পাহাড় জমিয়েছে।
এ সব টাকা পাচার রোধ খুবই কঠিন বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘টাকা পাচারের কারণ সবার জানা। আর পাচার ঠেকানোর দায়িত্ব বেশি হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। কিন্তু এখানেই বড় সমস্যা। শর্ষের মধ্যেই ভূত। এ প্রতিষ্ঠানটির একটি গোয়েন্দা সংস্থা আছে। কিন্তু সমস্যা এমন দাঁড়িয়েছে, এদের নজরদারির জন্য আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থা দরকার। এ অবস্থায় টাকা পাচার ঠেকানো মুশকিল।’
তিনি বলেন, ‘যত টাকা পাচারের তথ্য আসছে, তার সবই অবৈধ নয়। নানা কারণে বৈধ টাকাও বিদেশে পাচার হচ্ছে। তাই এসব অর্থ ঠেকানোর জন্য দেশে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুটি পথে টাকা পাচার হয়েছে। কানাডার বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম যারা বানিয়েছে তারা টাকা পাচারের ক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যবহার করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের রোজগারের টাকা দেশে পাঠানোর সময় টাকা পাচারকারী চক্র সেই টাকা সংগ্রহ করে সেখানেই বিনিয়োগ করেছে। পরে দেশে তাদের পরিজনকে সে টাকা দেশ থেকে পরিশোধ করেছে। দেশের ক্লনিক ব্যবসায়ীরাই সাধারণত এ কাজ করেছে। আর সুইস ব্যাংকে যারা টাকা রেখেছে, তাদের মধ্যে প্রবাসীদের বড় অংশ রয়েছে। তারা যেখান থেকেই টাকা রোজগার করুক অরিজিন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করেছে। এক্ষেত্রেও প্রবাসী আয় ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে এমন বক্তব্য এসেছে।  
দেশে যারা অসৎ উপায়ে টাকা কামাই করেছে তারা পাচার করছে। তারা টাকা দেশে ভোগ করতে পারে না, এ জন্য মালয়েশিয়ায় নিয়ে যায়, সিঙ্গাপুরে নিয়ে যায়, কানাডায় নিয়ে যায় এবং সেখানে স্ত্রী-সন্তানদের রাখে। তারা এ টাকা ভোগ করেন। এভাবে তারা দেশের কালো টাকা সাদা করছে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। খোলা কাগজকে তিনি বলেন, এ টাকার উৎস হচ্ছে বিভিন্ন রকম দুর্নীতি। এর মধ্যে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি রয়েছে। অন্যটি হচ্ছে- ক্লনিক ক্যাপিটালিস্ট ও খেলাপি। তাদের ঋণ খেলাপির কারণ হলো টাকা পাচার করা। এখানে সম্পদের সঙ্গে তাদের দায়দেনার মিল নেই। টাকা পাচারের অন্যতম উৎস হচ্ছে ঋণ খেলাপি।  
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, পাচার পুরোপুরি রোধ খুবই কঠিন। বাংলাদেশ বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত হওয়ায় এখানে যেমন টাকা আসতে পারে আবার বিদেশেও যেতে পারে। একটি পথ রোধ করা হলে পাচারকারীরা আরেকটি পথ আবিষ্কার করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ‘রিয়েল টাইম রিপোর্টিং সিসটেম’ চালু করার কারণে ‘ওভার আন্ডার ইনভয়েস’ ও ‘ওভার ইনভয়েস’ কমে এসেছে। এখন কোনো ব্যবসায়ী ব্যাংকে এলসি (ঋণপত্র) খোলার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ড্যাস বোর্ডে রিপোর্ট করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে বসেই বদলাতে পারছে এলসি খোলা সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য। বাংলাদেশ ব্যাংক দ্বৈব চয়নের ভিত্তিতে সত্যতাও যাচাই করছে। আবার  নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য দেশে আসা বা পণ্য বিদেশে রপ্তানি পণ্য বিদেশে না গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মাধ্যমে ওই এলসি খোলা প্রতিষ্ঠানকে ধরে ফেলছে। এভাবে ঋণপত্র কিছুটা হলে কমে এসেছে। তবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খুলে বিদেশ থেকে মেশিনের বদলে বালি আনার প্রমাণও মিলেছে।   
টাকা পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎপরতা প্রশংসনীয় বলে মনে করেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, ‘আমদানি-রপ্তানিতে ওভার ইনভয়েজ বা আন্ডার ইনভয়েজ হতো তা কিছুটা কমছে। তবে এখনো যে টাকা পাচার হচ্ছে না, তা বলা যাবে না। আরও যে মাধ্যমগুলো আছে সেগুলো এখনো সক্রিয় আছে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ (এপিজে) সক্রিয় সদস্য। টাকা পাচার রোধে এসব পথ বন্ধ করতে হলে এপিজে-এর মাধ্যমে তা খুঁজে বের করতে হবে কানাডার বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম এবং সুইজারল্যান্ডের সুইজ ব্যাংকে কীভাবে টাকা যাচ্ছে। এটা বের করতে পারলে টাকা পাচার সর্বনিম্নে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্য অনুযায়ী তারা ৩২টি এ ধরনের মামলা তদন্ত করছে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে পাওয়া। বাকি আরও কয়েকশ’ প্রাথমিক অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসন্ধান করছে।
এ প্রসঙ্গে আহসান এইচ মুনসুর বলেন, আইন তৈরি ও কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে টাকা পাচার করার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব। তবে দেশে কর্মসংস্থান, চাকরির পরিবেশ, সুশাসন ইত্যাদি নিশ্চিত করা গেলে বাকিটাও রোধ করা যায়; দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণ রোধ করা গেলে এ ধরনের টাকা পাচার কিছুটা রোধ করা যায়। এটা নিশ্চিত করা গেলে, খেলাপি, ক্লনিক ধনী ও  অসৎ রাজনীতিকদের দেশে ও বিদেশে সম্পদও চিহ্নিত করা যায়। আর তা হলেই টাকা পাচার কমে আসবে।
তিনি বলেন, টাকা পাচার রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। রাজনৈতিক প্রভাব ছিল বলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে কোকোর টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। সদিচ্ছার থাকলে এখনো যে সব টাকা পাচার হচ্ছে তা কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো। তবে দেশের বাইরে টাকা চলে গেলে তা ফেরানো খুবই কঠিন। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এ ক্ষেত্রে সদিচ্ছা যেমন একটি ব্যাপার। আবার কোর্টে প্রমাণ করা আরও কঠিন। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দেশে টাকা আনতে ৭ থেকে ২৩ বছর লাগার নজির আছে।

 
Electronic Paper