ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ধারদেনায় চলছে ইউনিয়ন ব্যাংক

জাফর আহমদ
🕐 ৮:২১ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০১৮

ধারদেনা করে চলছে চতুর্থ প্রজন্মের ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির আমানত ৯ হাজার কোটি টাকা। বিতরণ করেছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে ব্যাংকটিকে বিভিন্ন রকম বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। ফলে সব কিছু ঠিকঠাক রাখতে ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। আগস্ট মাস শেষে ব্যাংকটিতে ধারের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।


বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত যে কোনো ব্যাংক মূলধনের ৮৯ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারবে। কিন্তু ব্যাংকটি বিনিয়োগ করেছে ৯২ শতাংশের উপরে। ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত ইসলামী ধারার ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছে থেকে মোট মূলধনের ৮০ শতাংশ বরোয়িং বা ধার (শর্টটাইম ডিপোজিট স্কিম থেকে) করতে পারে। ইউনিয়ন ব্যাংক তাদের ৮৩০ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে ধার করেছে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটি ৮৩০ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে হোল সেল বরোয়িং করতে পারে ৬৬৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ধার করেছে প্রায় ছয় গুণ।

এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকটির কর্মকর্তারাই শঙ্কা প্রকাশ করছেন, যে কোনো সময় সমস্যায় পড়তে পারে ইউনিয়ন ব্যাংক। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকটিকে যে সব ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত ব্যাংক ধার দিয়েছে সে সব ব্যাংকও বিপদে পড়তে পারে।

হোল সেল বরোয়িং হলো- কলমানির চেয়ে বেশি সময়ের জন্য অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করা। হোল সেল বরোয়িং সাধারণত ৭ দিন, ২১ দিন, এক মাস এবং তিন মাস মেয়াদের হতে পারে। ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের শর্ট টার্ম স্কিম থেকে শরিয়া আইনের অধীনে এ ধরনের ধার করে থাকে। ইউনিয়ন ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, ইসলামী এই ব্যাংকটি আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ দেওয়ার কারণে বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণ করতে ও দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে এ ধরনের ধার করেছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ওমর ফারুক। তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে ধমকের সুরে জানতে চান, ‘আপনি এটা কোথা থেকে পেয়েছেন? আপনি কি জানেন? বলেন তো হোল সেল মানে কি, হোয়াট ইজ মিনিং অব হোল সেল?’ তিনি বলেন, ‘অন্য ব্যাংকের কাছে চাইলেই টাকা পাওয়া যায় না, এটা সহজ না।’

ইসলামী ব্যাংকিং করার উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষের আমানত খুব একটা আকর্ষণ করতে পারেনি ব্যাংকটি। প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরে ব্যাংকটির আমানত সংগ্রহের পরিমাণ ৯ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ ব্যাংকটির মূলধন দাঁড়িয়েছে ৮৩০ কোটি টাকা। জানা গেছে, একে তো নতুন ব্যাংক, তারপর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানা ও অন্যান্য কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক ওই শিল্প গ্রুপের কাছে চলে যাওয়ার কারণে খুব বেশি গ্রাহক টানতে পারেনি চতুর্থ প্রজন্মের এ ব্যাংকটি।

এ ধরনের ঘটনা রোধ করতে হলে ঘটনা ঘটার পর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। খোলা কাগজকে তিনি বলেন, ‘ঘটনা ঘটার আগে প্রত্যেকটা ব্যাংককে স্পষ্ট নির্দেশ দিতে হবে, যে সব নিয়মকানুন আছে, প্রুডেন্সিয়াল নর্মস আছে, ফাইন্যান্সিয়াল রুলস আছে-সেগুলো স্ট্রিক্টলি পরিপালন করতে হবে। এসএলআর, সিএলআর এবং সিঙ্গেল স্পোজার লিমিট রাখবে, ক্যাপিটাল এডোকেসি যতটা রাখার দরকার ততটা রাখবে। এটা একটা-দুটা গভর্নেন্স ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নয়, সবার জন্য প্রযোজ্য হতে হবে। বলতে হবে, এটা পরিপালন করতেই হবে। না করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

আগস্ট প্রান্তিকে ব্যাংকটির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আমানত সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধি ২২ শতাংশ। ব্যাংকটি লাগামহীনভাবে ঋণ বিতরণ করার ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণেও ভালো পরিস্থিতি নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, খেলাপিযোগ্য ঋণ থাকার পরও ‘উপরের চাপে’ এসব ঋণখেলাপি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। আবার এসব ঋণের থেকে আশানুরূপ মুনাফাও ব্যাংকে জমা হয় না। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দেখানো হয়েছে ৭৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা; যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১ শতাংশেরও কম। অথচ প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও বেশি। এ পরিস্থিতিতে ইউনিয়ন ব্যাংক যদি বিতরণ করা ঋণ ফেরত আনতে না পারে এবং আমানত সংগ্রহ করতে না পারে তাহলে আগামীতে সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে। আর এর প্রভাব পড়বে যে সব ব্যাংকের টাকা ধার করছে ওই সব ব্যাংকের ওপর। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক জানিয়েছেন, ইউনিয়ন ব্যাংককে নতুন করে ঋণ বিতরণ না করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে অনুযায়ী ঋণ বিতরণ সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে যে ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক অনুমোদন পায় সেগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড অন্যতম। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান ও একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি ব্যাংকটির মালিক বলে প্রচলিত থাকলেও ব্যাংকটির মূল কর্তৃত্ব দক্ষিণাঞ্চলের একটি শিল্পগোষ্ঠীর হাতে। দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংকসহ অপর একটি ইসলামী ব্যাংক ও আরও কয়েকটি ব্যাংকের কর্তৃত্ব রয়েছে একই শিল্প গ্রুপটির কাছে।
আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করা, অতিরিক্ত ঋণ বিতরণের জন্য অন্য ব্যাংকের কাছে নিয়মবহির্ভূত ধার করার কারণে ব্যাংকটির জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। ঋণ বিতরণের বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে ব্যাংকটির কয়েকজন কর্মকর্তার।

এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক বলেন, ‘এসব তথ্য আগস্ট মাসের। আর এখন অক্টোবর মাস।’ তাহলে যে ব্যত্যয় ছিল তা পূরণ হয়েছে কি-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন নতুন কোনো লেন্ডিং (ঋণ বিতরণ) হচ্ছে না। সেন্ট্রাল ব্যাংকের (বাংলাদেশ ব্যাংক) রেগুলেশন অনুযায়ী এডি রেশিও কমানোর জন্য অ্যাকচুয়ালি নতুন কোনো লেন্ডিং হচ্ছে না। এখন রিনিউয়াল (নবায়ন) ছাড়া নো নিউ ইনভেস্টমেন্ট, টোটালি এটা বন্ধ। মোটামুটি রিনিউয়াল ছাড়া কোনো কেসই বিবেচনায় নিচ্ছি না। সেন্ট্রাল ব্যাংকের পুরো মনিটরিংয়ে থাকি। ব্যত্যয় করার কোনো সুযোগ নেই। ইনভেস্ট কন্টেইন (লাগাম টেনে ধরে) করে সেন্ট্রাল ব্যাংকের ডিজায়্যার লেভেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করছি।’

এ ধরনের অনিয়ম রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যাংকে ঘটনা ঘটার আগে ব্যবস্থা নিতে হবে, পরে ব্যবস্থা নিলে কোনো কাজ হবে না। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। প্রয়োজনে কিছু শাখা বন্ধ করে দিতে হবে, নিয়োগ বন্ধ করে দিতে হবে। আইন না মানলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তো এগুলো করে না, আমরা এগুলো দেখছি না। শুধু সার্কুলার দিয়েই যদি ভাবা হয়, সবকিছু পরিপালন হবে-তাহলে এটা ঠিক নয়।’ তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যাংক অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শৈথিল্য দেখালে সেটা দৃষ্টান্ত হয়ে যাবে। অন্যরা একই ধরনের অনিয়ম করার সুযোগ পায়।’

একই সময়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া আরেক বেসরকারি ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকের আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ, ঋণ বিতরণে দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। প্রায় সব গ্রাহকই আমানত তুলে নেন। শেষে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের মাধ্যমে ৭০০ কোটি টাকার বেশি পুঁজি দিয়ে ব্যাংকটি বাঁচানোর চেষ্টা করে। তারপরও এখন পর্যন্ত ব্যাংকটি প্রত্যাশিত মাত্রায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সর্বশেষ খবর হলো, নাম পরিবর্তন করে ফারমার্স ব্যাংককে দাঁড় করানোর চিন্তাভাবনা চলছে।

 

 
Electronic Paper