অর্থনীতি চাঙ্গা করতে ঘরে-বাইরে ব্যস্ত সরকার
সৌদি বিনিয়োগ টানতে প্রচেষ্টা সফল, রাশিয়ায় রপ্তানি জটিলতা কাটানোর আহ্বান, এবার রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ৩৮ পণ্যে
সাজেদ রোমেল
🕐 ৯:০৩ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১
রপ্তানি বাড়াতে দেশ ও দেশের বাইরে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়ে নেমে পড়েছে সরকার। এরই মধ্যে চা, বাইসাইকেল, এমএস স্টিল ও সিমেন্ট শিটসহ ৩৮ পণ্যে নগদ সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। একদিকে নতুন বাজারে রপ্তানি বাড়াতে তদবির শুরু করেছে দেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে। গতকাল সোমবার রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে রপ্তানির জটিলতা নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গেছেন সৌদি আরবে। সেখানে সৌদি মন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগে দেশটি আগ্রহী। এটা তিনিসহ বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টার ফল হিসেবেই বিবেচনা করা যায়।
এবার রপ্তানিতে নগদ সহায়তা পাবে ৩৮ পণ্য : ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বস্ত্র খাতের ৫টি উপখাতসহ ৩৮টি পণ্য রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা পাবে। গত অর্থবছরের মতো এবারও ১% থেকে ২০% হারে নগদ সহায়তা প্রযোজ্য থাকছে। এর মধ্যে নতুনভাবে যুক্ত ৪টি খাতে ৪% হারে নগদ সহায়তা প্রদান করা হবে। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে দেশে উৎপাদিত চা, বাইসাইকেল ও এর পার্টস, এমএস স্টিল প্রোডাক্টস এবং সিমেন্ট শিট।
গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করা হয়।
সার্কুলার অনুযায়ী, এবার বিশেষায়িত অঞ্চলের (বেজা, বেপজা ও হাইটেক পার্ক) বিদ্যমান সহায়তার আওতা বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যমান সুবিধা ছাড়াও বিশেষায়িত অঞ্চলের ‘এ’ টাইপ ও ‘বি’ টাইপ প্রতিষ্ঠানের প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানির বিপরীতে ৪% হারে নগদ সহায়তা প্রযোজ্য করা হয়েছে। বিশেষায়িত অঞ্চলের সকল ক্যাটাগরিভুক্ত প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরে অন্যান্য পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ১% হারে রপ্তানি প্রণোদনা সহায়তা পাবে।
চলতি অর্থবছরে ব্যক্তি পর্যায়ের ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ৪% হারে নগদ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ফ্লোট গ্লাস শিট, ওপাল গ্লাসওয়্যার, কাস্ট আয়রন ও অ্যালুমিনিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য হালকা প্রকৌশল পণ্য খাতের আওতায় রপ্তানি ভর্তুকির জন্য বিবেচিত হবে। পাশাপাশি উচ্চ প্রযুক্তি সম্পন্ন পণ্য (কম্প্রেসার) এবং এইচসিএফসিমুক্ত রেফ্রিজারেটর ইলেক্ট্রনিক পণ্য হিসেবে কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিক্যাল হোম ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স খাতের আওতায় রপ্তানি ভতুর্কি প্রাপ্য হবে।
সার্কুলারে আরও বলা হয়েছে, প্রযোজ্য সব খাতে নগদ সহায়তা/রপ্তানি ভর্তুকি/প্রণোদনা সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রপ্তানির বিপরীতে ন্যূনতম ৩০% দেশীয় মূল্য সংযোজন থাকতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বরাবরের ন্যায় চলতি অর্থবছরের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে নগদ সহায়তা পরিশোধ বিষয়ে সার্কুলার জারি করা হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে প্রণোদনা সহায়তা বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বস্তি প্রদান করবে। আলোচ্য সময়ে সহায়তায় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সমস্যা কটিয়ে উঠতে পারবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বিনিয়োগে আগ্রহের কথা জানালেন সৌদি মন্ত্রী
বাংলাদেশের বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ রয়েছে উল্লেখ করে সৌদি বিনিয়োগ মন্ত্রী বাংলাদেশে আরও বেশি সৌদি বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। গতকাল রোববার সৌদি বিনিয়োগ মন্ত্রী খালিদ আল ফালিহ সৌদি সফররত প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠককালে এ আশাবাদব্যক্ত করেন।
বৈঠকে সালমান এফ রহমান বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ বর্ণনা করেন। পাশাপাশি সৌদি বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্ধারণ করার প্রস্তাব দেন। সৌদি বিনিয়োগ মন্ত্রী বাংলাদেশের এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সরকারি বেসরকারি অংশিদারিত্ব ব্যবস্থায় সৌদি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে খসড়া সমঝোতা স্মারকটি চূড়ান্ত করার জন্য অনুরোধ করেন।
উপদেষ্টা আরও বলেন, সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশের অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে সৌদি বিনিয়োগের সুযোগ প্রসারিত হবে। এ সময় সৌদি বিনিয়োগ মন্ত্রী জানান যে, সমঝোতা স্মারকটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং তা দ্রুত স্বাক্ষর হবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন। আলোচনাকালে সৌদি মন্ত্রী বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল খাতভিত্তিক বিনিয়োগ বিষয়ে সহযোগিতা চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান দুদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিনিধি দল বিনিময় এর গুরুত্ব তুলে ধরে সৌদি বিনিয়োগ মন্ত্রীকে আগামী নভেম্বর এর ২৮ ও ২৯ তারিখে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের অনুরোধ জানালে মন্ত্রী খালিদ আল ফালিহ তা সাদরে গ্রহণ করেন।
এর আগে উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সৌদি আরবের পরিবহন মন্ত্রী সালেহ আল জাসের এর সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় নির্মাণাধীন কনটেইনার টার্মিনালে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল কোম্পানির বিনিয়োগ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। পাশাপাশি তিনি ঢাকা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে সৌদি বিনিয়োগ প্রত্যাশা করেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের পরিবহন খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা যেতে পারে। এ সমঝোতা স্মারকের অধীনে দক্ষতা বিনিময়, প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রসমূহ অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে। এ সময় সৌদি পরিবহনমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
রাশিয়ায় রপ্তানিতে জটিলতা নিরসনের আহ্বান বাণিজ্যমন্ত্রীর
রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কিছু শুল্ক জটিলতা দূর করতে দেশটির সহযোগিতা চেয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বাংলাদেশে রাশিয়ার নতুন রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্দার ভিকেনতেভিচ মান্তিতস্কি সোমবার সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে তাকে এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়ার সম্ভাবনার দিকটি তুলে ধরে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন এবং কিছু শুল্ক জটিলতার কারণে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো যাচ্ছে না। বিভিন্ন জটিলতার কারণে অন্য দেশের মাধ্যমে রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পাঠাতে হচ্ছে।
জটিলতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর সমাধান হলে রাশিয়ার বাজারে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশের তৈরি পণ্য রপ্তানি করা সম্ভবপর হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন হিসাব-নিকাশের কারণে রাশিয়ার সঙ্গে অন্য দেশগুলোর বাণিজ্যে জটিলতা রয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেল লেনদেন নিয়েও সমস্যা রয়েছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত মান্তিতস্কি বলেন, বাংলাদেশকে রাশিয়া ‘বিশেষ গুরুত্ব’ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতেও তারা আগ্রহী।
বাণিজ্য বাধা দূর হলে উভয় দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়বে বলে তিনিও মনে করেন। তিনি আরও বলেন, রাশিয়া সরকার সমস্যাগুলো দূর করতে আন্তরিক।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ এখন উন্নত মানের পণ্য প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে সরবরাহ করতে সক্ষম দাবি করে তিনি বলেন, রাশিয়ার সহযোগিতায় বাংলাদেশ সিআইএসভুক্ত অন্যান্য দেশেও রপ্তানি বাড়াতে আগ্রহী।
গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৬৫ দশমিক ৩১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রাশিয়ায় রপ্তানি করেছে, একই সময়ে আমদানি করেছে ৪৬৬ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য।
সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ, অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) হাফিজুর রহমান, অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) নূর মো. মাহবুবুল হকসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কমকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।