ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মুনাফা বৃদ্ধি তবু ব্যাংকে কর্মী ছাঁটাই

করোনাকালে ৩,৩১৩ কর্মী ছাঁটাই

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
🕐 ৩:০০ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১

মুনাফা বৃদ্ধি তবু ব্যাংকে কর্মী ছাঁটাই

করোনাকালে ব্যাংকগুলো রেকর্ডসংখ্যক কর্মী ছাঁটাই, বরখাস্ত অথবা পদত্যাগে বাধ্য করেছে। দেশের প্রথম সারির ছয়টি বেসরকারি ব্যাংক গত ১৯ মাসে ৩ হাজার ৩১৩ কর্মীকে ছাঁটাই বা নানা অজুহাতে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার এক নির্দেশনায় তাদের সবার চাকরিতে পুনর্বহালের কথা বলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গত মে মাস পর্যন্ত করোনায় সারা দেশে ব্যাংকের ১৩৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী মারা গেছেন। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় দেড়শ’। আর গত মে মাস পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার ৩৯৯ জন। এ তথ্য থেকে বোঝা যায়, ব্যাংকাররা করোনার সময় কতটা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, করোনাকালে দেশের ছয়টি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ৩ হাজার ৩১৩ কর্মকর্তা চাকরি ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আবার কাউকে ছাঁটাই, অপসারণ ও বরখাস্ত করা হয়েছে। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৯ আগস্ট পর্যন্ত ছয়টি বেসরকারি ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব তথ্য জেনেছে। চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৭০ জন ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগ করেছেন বলে জানানো হয়েছে। আর ২০১ কর্মকর্তাকে অপসারণ, ৩০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত ও ১২ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে।

এ সময়ে ইস্টার্ন ব্যাংকের ২০১, সিটি ব্যাংকের ১ হাজার ৯৮, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ২৭৯, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৩৫, ব্র্যাক ব্যাংকের ১ হাজার ২১১ ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৪৬ কর্মকর্তা ‘স্বেচ্ছায়’ চাকরি ছেড়েছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এই সময়ে ডাচ্-বাংলার ১৪১ ও ব্র্যাক ব্যাংকের ৪৩ কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হয়েছে। একসঙ্গে এত কর্মকর্তার ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগকে বাংলাদেশ ব্যাংক অস্বাভাবিক বলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৃহস্পতিবারের নির্দেশনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ব্যাংকের কয়েক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। তাদের কেউ কেউ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় তারা এখন বেশ চাপে আছেন। কারণ, ওই নির্দেশনা তাদের মানতে হবে। বোর্ড মিটিং হলে বিষয়গুলো আলোচনা করে বোর্ড যেভাবে বলবে, সেভাবে তারা কাজ করবেন বলে জানান।

জানা যায়, কাগজকলমে স্বেচ্ছায় বলা হলেও বাস্তবে চাপের মুখে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ব্যাংকাররা। ছাঁটাই বা চাকরিচ্যুতির শিকার কর্মকর্তারা বকেয়া বুঝে পাওয়ার আতঙ্কে এবং আরও হয়রানির ভয়ে বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি বা মামলায় যাননি। মূলত ছাঁটাই হওয়া ব্যাংকারদের অস্বাভাবিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণের শর্ত দেওয়ার পর তা বাস্তবায়নের অজুহাতে ছাঁটাই করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।

বেসরকারি ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এমরানুল হক বলেন, ‘কিছু ব্যাংক তাদের খরচ কমানোর জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। করোনার সময় এমনিতেই মানুষ কষ্টের মধ্যে ছিল। পরিবার নিয়ে অনেক দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। জীবন ও জীবিকার ঝুঁকি নিয়েছে একসঙ্গে। এর মধ্যে যদি চাকরিও চলে যায়, তাহলে তো কিছুই থাকল না। আমরাও কষ্ট করেছি। তবে কাউকে চাকরিচ্যুত করিনি। সবাই মিলে কষ্ট করে চলেছি।

করোনাকালে জীবন বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকের পরই ফ্রন্ট যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছে ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। মানুষের টাকার প্রয়োজনে ব্যাংকে খোলা রাখতে হয়েছে। আর ব্যাংকে উপস্থিত থেকে সেবা দেওয়ার মধ্য দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে সেই কাজটি করেছেন ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কিন্তু শীর্ষ ব্যাংক বলে পরিচিত ব্যাংকগুলোই তাদের কর্মীকে ত্যাগের কথা ভুলে গিয়ে ছাঁটাই করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব কর্মীকে ফিরিয়ে আনতে বলেছে।

২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের যে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী সুনির্দিষ্ট ও প্রমাণিত কোনো অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও চাকরিচ্যুত হয়েছেন কিংবা চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের (আবেদনপ্রাপ্তি সাপেক্ষে) বিধি অনুযায়ী চাকরিতে বহালের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে কিংবা যারা চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছেন, তাদের তথ্য ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে।

মুনাফা বেড়েছে

বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের মধ্যেও ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাস জানুয়ারি-জুনে অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। মহামারীর অভিঘাত মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন ধরনের নীতি সহায়তা ও আমদানি-রপ্তানি ঘুরে দাঁড়ানের কারণে এ মুনাফা বেড়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, অন্যান্য বছরের মতো এবারো বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে এক হাজার ২০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে ইসলামী ব্যাংক, গত বছরের (২০২০ সাল) একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল এক হাজার সাত কোটি। এ হিসেবে গত বছরের তুলনায় ১৩ কোটি টাকা বেশি মুনাফা করেছে ব্যাংকটি। ইসলামী ব্যাংকের পরেই রয়েছে দ্বিতীয় প্রজন্মের সাউথইস্ট ব্যাংক। ছয় মাসে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার পরিমাণ ৪৭২ কোটি। ব্যাংকটির আগের বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা ছিল ৩৪২ কোটি টাকা।

এছাড়াও বছরের প্রথম ছয় মাসে প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৮ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৪৬ কোটি টাকা। তালিকায় এর পরের অবস্থান মার্কেন্টাইল ব্যাংকের। ছয় মাসে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মুনাফা ৩৫৮ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৪৩ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ২২৭ কোটি, যা তার আগের বছর ছিল ১৭৫ কোটি।

বছরের প্রথম ছয় মাসে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফা ছিল ৯১ কোটি টাকা। এক্সিম ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৩৪০ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩২৭ কোটি টাকা। আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ৩১০ কোটি টাকা, গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩০৫ কোটি টাকা। ঢাকা ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৩১০ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৬৩ কোটি টাকা।

বছরের প্রথম ছয় মাসে যমুনা ব্যাংক মুনাফা করেছে ৩০১ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৬২ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা, গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৮৬ কোটি টাকা। ব্যাংক এশিয়া ৪৮৩ কোটি টাকার মুনাফা করেছে, গত বছর যা ছিল ৩৫৩ কোটি টাকা। আর চতুর্থ প্রজন্মের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৮০ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই ছিল ৭০ কোটি টাকা। এছাড়াও বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে মৃতপ্রায় ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ২১ কোটি টাকা। তাদের গত বছরের একই সময়ে পরিচালন মুনাফার পরিমাণ ছিল ২২ কোটি টাকা।

ঢাকা ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে ৩১০ কোটি টাকা, গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২৬৩ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৩০১ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২৬২ কোটি টাকা।
বিশ^জুড়ে করোনা মহামারী চলছে। এর ফলে দেশে অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক বাণিজ্য সবক্ষেত্রেই চলছে মহামন্দা। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক ব্যবসা বাণিজ্য, কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যে সব প্রতিষ্ঠান সচল আছে সেগুলোও কর্মীদের বেতন কমিয়ে বা অন্যদিকে খরচ কমিয়ে টিকে আছে। মানুষের আয় রোজগার কমে যাওয়ার কারণে সঞ্চয়েও এর আঘাত পড়েছে। প্রভাব পড়েছে রপ্তানি বাণিজ্যেও। তবে রপ্তানি বাণিজ্য আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। অর্থনীতির এ চিত্র ব্যাংক খাতেও পড়েছে। তারপরও মুনাফা বৃদ্ধির কারণ হলো সরকারের বিভিন্ন রকম নীতি ছাড়।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে বিশেষ পুনঃতফসিল সুবিধায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণের খেলাপি ঋণ নিয়মিত হওয়ায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। তবে পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। পরিচালন মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ এবং সাড়ে ৩৭ শতাংশ হারে করপোরেট কর পরিশোধের পর ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফার হিসাব হয়। নিট মুনাফার ওপর ভিত্তি করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিয়ে থাকে।

এ বিষয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুবিধায় গ্রাহক টাকা পরিশোধ না করেও নিয়মিত হয়েছেন। গত বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় এ বছরের একই সময়ে আমদানি-রপ্তানি নতুন মাত্রা পেয়েছে। এসব কারণে ব্যাংকগুলো ভালো মুনাফা করেছে।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper