ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রতারণায় বিশ্বাস ভাঙছে গ্রাহকপ্রিয় ই-কমার্স

প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১৮, ২০২১

প্রতারণায় বিশ্বাস ভাঙছে গ্রাহকপ্রিয় ই-কমার্স

করোনায় গ্রাহকপ্রিয় হয়ে ওঠে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। এ সময়ই প্রতারণার অভিযোগও ওঠে জনপ্রিয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আস্থা হারাতে শুরু করেছে ই-কমার্স ব্যবসা। সম্প্রতি ইভ্যালি, ধামাকাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে তদন্তে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) বেশ কয়েকটি সংস্থা।

তদন্ত সংস্থাগুলো বলছে, এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কেউ কেউ মাত্র ১০ শতাংশ গ্রাহকের অর্ডার করা পণ্য সরবরাহ করে। বাকি গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ করে পণ্য সরবরাহে গড়িমসি করছে। আবার কেউ কেউ ই-কমার্সের নামে নিষিদ্ধ এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা করছেন। আবার কেউ কেউ গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের পর দেশ ত্যাগ করছেন, বিদেশে পাচার করছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।

সিআইডির নজরদারিতে ১৪টি ই-কমার্স : সাম্প্রতিক সময়ে ইভ্যালির নানা অনিয়ম প্রকাশ্যে আসার পর দেশের ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিয়ে তদন্ত শুরু করে সিআইডি। তদন্তে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের তথ্য পান সংশ্লিষ্টরা। এরপরই ইভ্যালি, আলেশা মার্ট, ধামাকা, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদীনের প্রদীপ, কিউ-ডটকম, বুমবুম, আদেন মার্ট , নিডস, দালাল, এসকে ট্রেডাস ও মোটরসের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে সিআইডি। আলোচিত ১৪টি ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টির সঙ্গে ইতিমধ্যে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডে লেনদেন বন্ধ করেছে ব্যাংক এশিয়া, ব্র্যাক ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকসহ বেশ কিছু ব্যাংক। সিআইডির

অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান খোলা কাগজকে বলেন, ‘বেশ কয়েকটি ই-কমার্স সাইটকে দেখা যাচ্ছে তারা ছদ্মবেশী ফর্মে মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করছে। আর্থিক নীতিমালা অনুযায়ী কোনো অবস্থাতেই তারা এটা করতে পারে না।’ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সাইবার স্পেস ব্যবহার করে কাস্টমারের সঙ্গে যে প্রতারণা করছে, তার ছায়া তদন্ত করছে সিআইডি। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারও এসব ঘটনার কিছু অংশের তদন্ত করছে। আমরা তদন্ত করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করব।’ লেনদেনের টাকা সরাসরি চলে যায় বিদেশে

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা তথ্য পেয়েছেন বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের টাকা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে যাচ্ছে না। পণ্য বিক্রির টাকা সরাসরি চলে যাচ্ছে বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টে। আলেশা মার্টে পণ্য বিক্রির টাকা সরাসরি একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্টে যাওয়ার অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। এছাড়া কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে তাদের অবৈধ কাজে সহায়তা করছেন।

৫০ কোটি টাকা সরিয়েছে ধামাকা : এদিকে ই-কমার্স কোম্পানি ধামাকা শপিং ডটকম গ্রাহকদের থেকে অগ্রিম নেওয়া অর্থ অন্যান্য ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাচার করেছে বলে জানিয়েছে সিআইডি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ধামাকার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য মিলেছে। তদন্ত প্রায় শেষপর্যায়ে। আগামী মাসে সিআইডি বাদী হয়ে মামলা করবে।  সূত্র আরও জানায়, ধামাকা ইতিমধ্যে তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা সরিয়েছে- তার প্রমাণ মিলেছে। কোম্পানির বিজনেস মডেলেও সমস্যা রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এরই মধ্যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।

প্রতারিত হয়েছেন হাজার হাজার গ্রাহক : সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ডাবল ভাউচার, সিগনেচার কার্ড ও বিগ বিলিয়ন রিটার্নস এবং অস্বাভাবিক মূল্য ছাড়ের ফাঁদে ফেলে হাজার হাজার গ্রাহককে প্রতারিত করছে এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। তারা প্রতারণা করে এসব অর্থ আত্মসাৎ করতে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

ইভ্যালির চেয়ারম্যান-এমডির বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা:
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন এবং এমডি মো. রাসেলের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। গতকাল আদালতের দুদক জিআর শাখা থেকে জানা যায়, গত ১৫ জুলাই মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েস এ আদেশ দেন। সূত্র জানায়, দুদক অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশত্যাগ করলে সার্বিক অনুসন্ধান কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে বলে প্রতীয়মান হওয়ায় গত ৮ জুলাই  ইভ্যালির এমডি মো. রাসেল এবং চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় সংস্থাটি।

গত ৮ জুলাই ইভ্যালির গ্রাহক ও মার্চেন্টের ৩৩৯ কোটি টাকার হদিস না থাকার বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। টাকাগুলো আত্মসাৎ অথবা পাচার হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে দুদক থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।

বন্ধ ইভ্যালি কার্যালয়, সময় চাইলেন এমডি : রাজধানীর ধানমন্ডির সোবহানবাগ এলাকায় ইভ্যালির কার্যালয়টি বন্ধ রয়েছে। গ্রাহকরা কার্যালয়টিতে ভিড় জমালে দেখা যায় সেটি বন্ধ। তবে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল দাবি করেছেন, করোনার কারণে অনলাইনে কাজ চলছে। কার্যালয়ে দুটি নোটিস ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা গেছে। নোটিসে বলা হয়েছে, ইভ্যালির সশরীর গ্রাহকসেবা প্রদান বন্ধ থাকবে। অনলাইন গ্রাহকসেবা ও পণ্য সরবরাহ চালু থাকবে। গত শুক্রবার রাতে নিজের ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট থেকে একটি স্ট্যাটাস দেন ইভ্যালির এমডি মো. রাসেল। সেখানে তিনি ইভ্যালিকে আরেকটু সময় দিতে গ্রাহকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন জানান।

স্ট্যাটাসে রাসেল বলেন, ‘ইভ্যালির পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামত সোশ্যাল মিডিয়াতে পেয়েছি এবং দেখেছি। এতদিন ইভ্যালির যে লস সেটা শুধু বিজনেস ডেভেলপমেন্টের এই ইনভেস্টমেন্ট গিয়েছে। এখন ইভ্যালির অর্গানিক সেলস অনেক বেড়েছে। অনেকে এ সময় মতামত দিচ্ছেন বন্ধ করে পুরাতন অর্ডার ডেলিভারি করা হোক। কিন্তু এখন তো আমরা অগ্রিম টাকা পাই না। গত দুই সপ্তাহ কীভাবে তাহলে পুরাতন অর্ডার থেকে ৪০ কোটি টাকার অধিক ডেলিভারি করা হলো আমরা বড় বড় সেলারদের ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি পেমেন্ট দিয়েছি। তারা আমাদের পাশে থাকতে চান। কিন্তু মিডিয়া অথবা সোশ্যাল মিডিয়া যখন ডেসটিনির মতো কোম্পানির সঙ্গে তুলনা করে, তখন যে কেউ ই ভয় পেয়ে যান। আমরা বিজনেস সবাই বুঝি। এটা একটা চলমান সম্পর্কে থাকার বিষয়। সেলস থাকলে সেলার থাকবে এবং সেলার থাকলে পণ্য থাকবে।’

রাসেল বলেন, ‘ইভ্যালি নিয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী। এবং এর চেয়েও বেশি আশাবাদী ই-কমার্স নিয়ে। বিদেশি প্রতিষ্ঠান অসধুড়হ আসলে আমরা খুশি হব স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের কেউ ই-কমার্স লিড দেবে এটা আমি শতভাগ নিশ্চিত। কারণ আমরা এখন সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল জাতি। আমাদের একটু সময় দিন।’

এদিকে ইভ্যালির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বেশ কিছু পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাউচারের বিপরীতে পাওনা অর্থ পরিশোধ না করায় পণ্য দিচ্ছে না। সম্প্রতি ইভ্যালির গিফট ভাউচারে কেনাকাটার নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞপ্তিও দেয়।

 
Electronic Paper