ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাজেট আলস্যের নাকি জেদের

সাজেদ রোমেল
🕐 ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ, জুন ০৫, ২০২১

বাজেট আলস্যের নাকি জেদের

মহামারীর মতো কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করোনা এবং জনজীবনে এর ভয়াবহ প্রভাব মোকাবিলায় সৃজনশীল বাজেট আসেনি। এ সময়ে জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধি পাবে না বলে এবং মেগাপ্রকল্পগুলোও আপতত অত্যবশ্যকীয় নয় জেনে এসব খাতে বরাদ্দ কমাতে নানা মহল বলে আসছে আগে থেকেই। সে টাকায় হঠাৎ দারিদ্র্যে পড়া কয়েক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষায় নতুন কর্মযজ্ঞ চালানোর পরামর্শ ছিল তাদের।

সরকার সব জেনেবুঝে কেন গতানুগতিক চেনা পথেই হাঁটল, এমন প্রশ্নে কূল-কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার যখন মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, মহামারীতেও তাতে টাকা ঢালতেই হবে, এমন জেদ থেকে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে গুয়ার্তুমি করে চলেছে সরকার। করোনাকালে বিপদগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যাপক কর্মসূচি সফল করতে আগে-পরে কাগজে-কলমে ও মাঠে-ময়দানে যে শ্রম দিতে হবে, তা নিয়ে নামতে অলসতাও থাকতে পারে।

এজন্য বহু বছরের চর্চিত ছাঁচেই মুখস্থ খাতগুলোতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। টিকার জন্য ১৪ হাজার ২০০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ ছাড়া মহামারীর জন্য তেমন কোনো বড় কর্মসূচি নেওয়া হয়নি।

বাজেট তৈরির কাঁচামাল পরিসংখ্যানও অপর্যাপ্ত : সমালোচনা যাই থাকুক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিবিএসই হচ্ছে বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা, আয়-রোজগারসহ জনমিতি, পরিসংখ্যান ও অর্থনীতি চালচিত্র জানার একমাত্র মাধ্যম। করোনাকালে এই প্রতিষ্ঠানটিকে যে বহুবিধ ব্যবহারের সুযোগ ছিল, সেদিকেও নজর দেয়নি সরকার। করোনায় দেশের সাড়ে তিন কোটি লোক নতুন করে দরিদ্র হয়েছে বলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক দাবি করেছিল। সরকার তা নাকচ করলেও নিজেদের বিবিএস দিয়ে সারা দেশে ব্যাপক কোনো জরিপ চালায়নি। প্রতি বছর সংস্থাটি যে রুটিন কাজ করে সারা দেশে, তার সঙ্গে করোনায় জীবন-জীবিকার প্রভাব নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক জরিপ চালানোর সুযোগ ছিল। তাতে যেমন হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যেত, তেমনি করোনার কারণে বেকার কোটি কোটি শিক্ষার্থী, যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করা যেত। সবচেয়ে বড় কথা, কাদের সাহায্য প্রয়োজন, তাদের সংখ্যা, সাহায্য পৌঁছানোর উপায় এবং সরকারের জন্য লাভজনক কোনো মহাপরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করা যেত। গতকাল শুক্রবার স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘নতুন দরিদ্রদের হিসাব সরকারের কাছে নেই। বিবিএস কিছু কিছু কাজ করছে। এগুলো শেষ হলে বলা যাবে নতুন দরিদ্র কত জন।’
অর্থাৎ সরকারের কাছে নতুন দরিদ্রদের হিসাবই নেই, তাদের জন্য কর্মকৌশল ঠিক করা তো অনেক পরের ব্যাপার।

আগের বাজেটগুলো ঘষামাজা করেই নতুন বাজেট : ৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশের বাজেট কাগজে-কলমে হলেও অনেক বেশি সুসংগঠিত। আয়-ব্যয়-ঘাটতির এই অনুমানপত্রটা সুখপাঠ্য। এনবিআর ও এনবিআর বহির্ভূত কর এবং করবহির্ভূত আয় দিয়ে সাজানো আয়ের লক্ষ্যকে ভেঙে ভেঙে অর্থমন্ত্রীরা যখন বলেন, তা শ্রুতিমধুর হয়। আবার খরচের কথা বলার সময় বেতন-ভাতাসহ রাজস্ব ব্যয়ের পর যখন তিনি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির কথা বলা শুরু করেন, সাধারণ শ্রোতারা পুলকিত হন। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট যখন অর্থমন্ত্রী পেশ করছেন, তখন জীবনে হাত পাতেননি, এমন মানুষও নিরন্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। কোটি কোটি মানুষের কাছে অভাব যখন নতুন বিষয়, তখন পুরাতন ঢঙ্গের বাজেট দিলেন আ ম হ মুস্তফা কামাল। মহামারীকালে মানুষকে বাঁচাতে রাষ্ট্র সব ছেড়ে ছুড়ে করোনা এবং এর ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন না, সৃজনশীল কোনো কিছু করার আগে জমিন তৈরির চেষ্টাই যে বাজেট তৈরির আগে সরকার করেনি, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাজেট পেশের পর।

অভাব ঘোচাতে বড় পরিবর্তন আসেনি, এটা মানা যায় না : বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। এডিপিতে মানবসম্পদ (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) খাতে ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ, সার্বিক কৃষি খাতে ২১ দশমিক ৪ শতাংশ, বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতে ১২ দশমিক ১ শতাংশ, যোগাযোগ অবকাঠামো (সড়ক, রেল, সেতু ও যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) খাতে ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, লকডাউনে চলাচল বন্ধ থাকছে কিছুদিন পরপর। শিল্পে ভাটা পড়ায় বিদ্যুৎ ও জ¦ালানির চাহিদা কম। এ সময় এসব খাতে বরাদ্দ কমিয়ে তা নতুন দরিদ্রদের সহযোগিতার কৌশল বের করা যেত। ছোট ও মাঝারি শিল্প ও খামারসহ শ্রমঘন শিল্পে প্রণোদনাও দেওয়া যেত অনেক পরিমাণে।

বাজেটের ঘাটতি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মূল্যায়নটি নতুন : দশকের পর দশক অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন, ৫ শতাংশের নিচে ঘাটতি থাকলে সেটা বড় কোনো সমস্যা নয়। তবে এবার যে ঘাটতি কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ হতে যাচ্ছে তা আগেই ধারণা করছিলেন অর্থনীতিবিদরা। বাজেটের আগে অর্থনীতিবিদরা বলে গেছেন, কম আয়ের শঙ্কার মধ্যে ব্যয় বাড়াতে ঘাটতি ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলেও তেমন সমস্যা হবে না। তবে বাজেট পেশের পর দেখা গেল, ঘাটতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

এবার সিপিডিসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতিবিদ এই ৬ শতাংশের বেশি ঘাটতি যে, অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর সেটি বলছেন। তাদের শঙ্কাটা ঘাটতি পূরণ হবে কি না, কোথা থেকে কীভাবে এ ঘাটতি পূরণ হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তাদের। ৫ শতাংশের নিচে ঘাটতি অর্থনীতির জন্য স্বাস্থ্যকর মানলে তার বেশি হলে অশনি সংকেত তা জোরগলায় বলছেন না সিপিডি, সায়েম, বিআইডিএসসহ কোনো অর্থনৈতিক বিশ্লেষক সংস্থা বা ব্যক্তিবিশেষ।

বাজেট প্রস্তাবেই উচ্ছ্বসিত মন্ত্রীরা : ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রীরা বাজেট দেওয়ার পর থেকেই নানা উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলে চলেছেন। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নানের বক্তব্যই সবার মনোযোগ কেড়েছে। অর্থমন্ত্রী গতকাল শুক্রবার বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদ দেখিয়ে বলেন, ‘২০১৯ সালের জুনে বলেছিলাম, এখন আমরা ঋণ নেব না, ঋণ দেব। আজ আমাদের ঋণ দেওয়ার সময় এসে গেছে।’

অন্যদিকে একই দিন গতকাল শুক্রবার পরিকল্পনামন্ত্রী ঘাটতি মেটাতে ধারদেনা করার ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, ধারের বাজার ভালো, বিদেশিরা আমাদের ধার দিতে চায়। আমাদের সুনাম আছে। আমরা নিয়মিত দেনা পরিশোধ করি।’

অর্থাৎ এক মন্ত্রীর মুখে নিজেদের ঋণ দেওয়ার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার চিত্র সাফল্য এবং আরেক মন্ত্রীর মুখে ঋণ পাওয়ার সক্ষমতা ও আশাবাদের গল্প। কিন্তু মহামারীতে কোটি মানুষের জীবনের করুণ গল্পকে বুকে নিয়ে তাদের স্বার্থে পরিকল্পনা সাজানোর তথ্যসংবলিত বর্ণনা বাজেট বক্তৃতায় ছিল অনুপস্থিত। বাজেট-পরবর্তী বক্তব্যেও বাজেট সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রীর মুখে তার কোনো চিত্র নেই।

 
Electronic Paper