বাংলাদেশ ব্যাংকের বইয়ে পাকিস্তানের ভূত
অবশেষে তদন্ত হচ্ছে
জাফর আহমদ
🕐 ১০:৩৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০২, ২০১৮
‘বাংলাদেশের ব্যাংকের ইতিহাস’ বইয়ে বিকৃতির বিষয়টি তদন্ত করতেই হচ্ছে। ‘আপাতত তদন্ত নয়, রিভিউ প্রধান প্রায়রিটি’-বলে বাংলাদেশ ব্যাংক যে কথা জানিয়েছিল সে অবস্থানে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে এক মাসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইয়ে ইতিহাস বিকৃতি অভিযোগ তদন্তে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। রিট আবেদনকারীর আইনজীবী এ বি এম আলতাফ হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, অর্থ সচিবকে একটি অনুসন্ধান কমিটি করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গতকাল খোলা কাগজকে বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশ অবশ্যই পালন করতে হবে।
ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকাকালে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বইয়ের প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। এ বিষয়ে উপদেষ্টা কমিটি ও সম্পাদনা কমিটি নামে দুটি কমিটিও করা হয় সে সময়। পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করার পর ২০১৭ সালে ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’। চলতি বছরের ২৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন বর্তমান গভর্নর ফজলে কবির।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর দৈনিক খোলা কাগজে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বইতে পাকিস্তানের ভূত : ঠাঁই পাননি বঙ্গবন্ধু, আছে স্বৈরাচার আইয়ুব খান’ এবং ১৪ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস বইয়ে পাকিস্তানের ভূত : দুরবিনেও মেলে না প্রধানমন্ত্রী ও আ.লীগের অবদান’ শীর্ষক দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এ সংবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান বিষয়টি তদন্ত করা হবে। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিবৃতি দিয়ে জানায়, বইটি সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে খোলা কাগজের এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানানো হয়, ‘আপাতত বইটি রিভিউ করা ফাস্ট প্রায়রিটির কাজ। প্রকাশিত বইয়ে ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে কারা জড়িত আছে-এ ব্যাপারে এখন তদন্ত নয়’। গত ১৮ ডিসেম্বর খোলা কাগজে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইয়ে পাকিস্তানের ভূত, তদন্ত ছাড়াই রিভিউয়ের উদ্যোগ’ শীর্ষক আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
খোলা কাগজে প্রকাশিত এসব সংবাদের পর গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশের ব্যাংকের ইতিহাসে বইয়ে বিকৃতি তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি অন্তর্ভুক্ত না করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং ইস্ট পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের ছবি অন্তর্ভুক্ত করে ইতিহাস বিকৃত করা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না-তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। অর্থ মন্ত্রণালয় সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় সচিবসহ ছয়জনকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এফবিসিসিআই পরিচালক কাজী এরতেজা হাসান আদালতে এই রিট আবেদন করেন। রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এ বি এম আলতাফ হোসেন; সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী অর্পণ চক্রবর্তী ও কামরুজ্জামান কাকন।
গতকাল সন্ধ্যায় হাইকোর্টের এ আদেশের বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম খোলা কাগজকে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশটি আমরা এখনো দেখিনি। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশ অবশ্যই পালন করতে হবে।
৩৬১ পৃষ্ঠার ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাস’ বইটিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কোনো ছবি নেই। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিকভাবে বইটিতে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট স্বৈরশাসক আইয়ুর খানের একক ও গ্রুপভাবে পাঁচটি ছবি স্থান পেয়েছে। প্রেসিডেন্ট অর্ডারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ব্যাংকের সৃষ্টি করেন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, গভর্নরকে সঙ্গে করে স্বাধীন বাংলাদেশের নোট উদ্বোধনও করেন তিনি। সেসব ছবি সহজলভ্য হলেও কৌশলে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, রূপালী, পুবালী, জনতা, অগ্রণীর মতো নান্দনিক নামগুলো বঙ্গবন্ধু দিলেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে এসব ব্যাংককে জাতীয়করণ করা হয়েছিল রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতে। কিন্তু ইতিহাস বইয়ে বলা হয়েছে, পাকিন্তানি মালিকরা ফেলে যাওয়া ব্যাংকগুলো জাতীয়করণ করা ছাড়া উপায় ছিল না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসের বইটিতে প্রথম দ্বিতীয় প্রজন্মের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোটামুটি এলেও চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কোনো কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংককে দুই লাইনে শেষ করা হয়েছে। অথচ গ্রামীণ ব্যাংকের মতো বিশেষায়িত ব্যাংককে স্থান দেওয়া হয়েছে ১৫২ পৃষ্ঠা থেকে ১৫৭ পর্যন্ত ছয় পৃষ্ঠাজুড়ে।