‘কঠোর লকডাউনের’ পর কর্মস্থল ফিরে পেয়ে খুশি শ্রমজীবী মানুষ
জাফর আহমদ
🕐 ২:২৯ অপরাহ্ণ, মে ১০, ২০২১
শ্রমজীবী মানুষ কাজ ফিরে পেয়েছে তাতেই যেন তাদের হাজারো পাওয়া। করোনায় সর্বাত্মক ‘কঠোর লকডাউনে’ এসব মানুষের জীবন অনেক বিষিয়ে উঠেছিল। লকডাউন খুলে দেওয়া পর সবাই কাজে বের হয়ে পড়েছেন। নিজের কর্মস্থলে বসতে পেরেছেন। এতে যেন তাদের সব ইচ্ছে পূর্ণ হয়ে গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন কর্মজীবী মানুষের সাথে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
একদিকে নগরবাসীর ঈদে বাড়ি ফেরার তোড়জোড়; ধুমছে কেনাকাটা। অন্যদিকে কাজ গুটিয়ে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার পর্ব চলছে। এর মধ্যে খুশি মনে কাজ করে চলেছেন রাজধানীর একেবারে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ। ঈদের আগে এই করোনার কঠোর লকডাউন খুলে দেওয়ার ফলে কাজ করতে পারা যেন তাদের কাছে সাত রাজার ধন হাতে পাওয়া। সাহেবদের জুতাটি কালি করে পাঁচ টাকা বোনাসসহ মজুরিটা হাতে পাওয়া মুচি, পাহাড় সমান জ্যাম ঠেলে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টায় থাকা রিকশাওয়ালা ও ঠেলাগাড়িওয়ালা, মার্কেটের মুটে, দোকানের কর্মচারী, গণপরিবহনের চালক-হেলপার সবাই নিজের কাজটি নিয়ে ব্যস্ত। লকডাউন শিথিলের এই সময়টায় কাজটি করে ঈদের কেনাকাটার রোজগারটা করে নিতে চান তারা। ব্যস্ততার মাঝেও তৃপ্তির ঝিলিক তাদের মাঝে। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যেও ঈদের আগে যেন মহাখুশির আলপনা আঁকছেন স্বীয় অবয়বে। কাজ করতে হবে, বাড়িতে যেতে হবে, বাড়িতে সন্তান-পরিজনের কাছে নতুন জামা কেনার টাকা পাঠাতে হবে।
শ্রমজীবী এসব মানুষের সব কষ্ট মুছে গেছে কাজ ফিরে পাওয়ার জয়ানন্দে। যেন কবি শুকান্তের নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কষ্ট কেনা ডাকহরকরা। ‘এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে, এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে।’
রনজিত দাশ কাজ করছিলেন মতিঝিলের ইউনুস টাওয়ারের উল্টো দিকের ফুটপাতে। হাতে একটি জুতা। আরও দুজন সামনে দাঁড়িয়ে। তারাও জুতা সেলাই ও কালি করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। রনজিতের কাজ ফেলে রেখে কথা বলার সময় নেই। তার মধ্যেও একটু কাজ থামিয়ে বললেন, ‘লকডাউনের মধ্যে কাজ ছিল না, আয় ছিল না। নিজে এসে বসেছিলাম। গাড়ি না চলার কারণে মানুষের আনাগোনা ছিল না, কাজ করোনার লোকও ছিল না। লকডাউন নেই। এখন আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। লোকের লোকারণ্য। কাজ করছি, ঈদে বাড়তি খরচ আছে। সবাই নতুন জামা-কাপড় পরবে, ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীর জন্য নতুন কাপড় লাগবে। কাজও আছে। এখন বাড়তি কাজ আছে, করতে চাই। এভাবে স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকলেই ভালো। আমরা কাজ করে খেতে চাই, সাহায্য চাই না। অফিস খোলা থাকুক, লোকজন আসুক তাতেই খুশি।’
লডকাউন শিথিলের ফলে মার্কেট ও পথ মানুষের স্রোত গতি পেয়েছে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে ঈদের কেনাকাটা। দোকানগুলোর বিক্রির পাশাপাশি মার্কেট কেন্দ্রীক মুটে, ঠেলাগাড়ি, ভ্যান-রিকশার কাজ বেড়েছে। করোনার কঠোর লকডাউনে এসব মানুষের কাজ ছিল না। কাজ না থাকাকালে তারা ধারা-দেনা করে চলেছে। লকডাউন খুলে যাওয়ার পর এখন অনেক কাজ করতে হচ্ছে। ক্রেতারা বেশি বেশি মার্কেটে আসছে, ক্রয় করছে। এসব কর্মজীবী মানুষের কোনোদিকে তাকানোর সময় নেই।
মিরপুরের স্টেডিয়াম মার্কেটে ভ্যানে শো-কেস সাজিয়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন আমির আলী। যাবেন ষাট ফিট এলাকার একটি বাসাতে। চারশ টাকা ভাড়া। বললেন, ‘এখন কথা বলার সময় নেই। পৌঁছে দিয়ে আবার ভাড়া ধরতে হবে। লকডাউনের মধ্যে কাজ ছিল না, এখন মানুষ আসবাবপত্র কিনতে আসছে বেশি। ভাড়াও হচ্ছে।’ তারপর ভ্যানের প্যাডেলে চাপ দিয়ে চললেন গন্তব্যে।
করোনার মধ্যে কঠোর লকডাউন হলেই চরম দুর্দশা নেমে আসে পরিবহন শ্রমিকদের। রাজধানীর সব মহল্লাতেই এমন মানুষের চিৎকার কানে ভেসে আসে ‘খালাম্মা আমি গাড়ির হেলপার, কাজ বন্ধ, খাওয়ার নেই। কিছু সাহায্য দেবেন’। কোনো কোনো শ্রমিক গাড়ির মালিকের দ্বারস্থ হয় গাড়ি রঙ করার বা অন্য কোনো কাজের জন্য। কেউ কেউ পেয়েও যায় এ ধরনের বিকল্প কাজ। তাতে কিছুটা হলেও সংসারটা চালিয়ে নিতে সহায়ক হয়। কিন্তু বড় অংশ থাকে ধার দেনা ও উপোস করে। শর্তসাপেক্ষে গাড়ি চলাচল শুরু হওয়াতে অনেক খুশি এসব পরিবহন শ্রমিক। মিরপুরের ১০ নম্বর গোল চক্করে টিসিএল গাড়ির হেলপারের অনুভূতি পুরো অন্য রকম। বললেন, ‘ভালো আছি। আবার পত্রিকায় লেখি লকডাউন করবার চাও? তুমার সাথে কথা বুলার সুমায় নাই।’ তারপর শোঁ শোঁ করে চলে গেল গণপরিবহনটি।
করোনার মহামারীতে মানুষ মরছে, আক্রান্ত হচ্ছে-এমন খবর আছে এই সব খেটে খাওয়া মানুষের কাছে। এজন্য তারা শঙ্কিত নন কিন্তু বেশি শঙ্কিত তারা কাজ না থাকার কারণে, আয় না থাকার কারণে, পরিবারের সবার মুখে দু-বেলা দুমুঠো খাবার দিতে না পারার কারণে। পরিবারের পরিজনের নিরন্ন মানুষগুলোর বিবর্ণ মুখ দেখতে দেখতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সরকার যে অল্প সহায়তা দিয়েছে তাও যথেষ্ট না, আবার অধিকাংশ মানুষ পাননি। লকডাউন খুলে দেওয়ার পর সকল দুঃখ কষ্ট যেন ভুলে গেছেন। কর্মস্থলে ফিরে পাওয়াতে যেন খুশি তারা, চান এ খুশি থাকুক জীবনভর।