রেমিট্যান্স বেশি আসছে উন্নত বিশ্ব থেকে
সাজেদ রোমেল
🕐 ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ, মে ১০, ২০২১
বৈশ্বিক মহামারীতেও বাংলাদেশের প্রবাসী আয় বেড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি প্রবাসী আয়ের উৎসমুখ পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য নির্ভরতা কমে ইউরোপ-আমেরিকা উন্নত দেশ থেকে থেকে রেমিট্যান্স আসার হার বাড়ছে। তবে করোনাকালে হঠাৎ প্রবাসী আয় বৃদ্ধির পেছনে পাচার করা টাকার বৈধ করার প্রয়াস কাজ করছে কি-না, তা খতিয়ে দেখার তাগিদ দিয়েছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।
প্রণোদনার কারণে করোনাকালে বৈধপথে প্রবাসী আয় বেড়েছে : প্রবাসীদের বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী করতে সরকার ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে দুই শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে আসছে। সরকারের দুই শতাংশের সঙ্গে কয়েকটি ব্যাংক আরও এক শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার সুফল পাচ্ছে।
বাড়তি প্রণোদনার সুফল মেলায় এবার প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় রেমিট্যান্সের প্রণোদনা দুই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে চার শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দশমাসেই রেমিট্যান্স এসেছে দুই হাজার ৬৬টি ডলার। ঈদকে সামনে রেখে এপ্রিল মাসে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ২০৬ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স। ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে রেমিট্যান্সের প্রণোদনা দেওয়া শুরু হলেও বৈধপথে প্রবাসীরা এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন, যা আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় মাত্র ১৭৯ কোটি ডলার বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন এক হাজার ৬৪১ কোটি ডলার।
বৈধপথে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে করোনা মহামারীর মধ্যে গেল বছরের শুরুর দিকে ব্যবসার কৌশল হিসেবে সরকারের দুই শতাংশ প্রণোদনার সঙ্গে বাড়তি আরও এক শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দেয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংক। পরবর্তীতে অগ্রণী ব্যাংক এবং বেসরকাররি খাতের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড বাড়তি প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে। ১০ হাজার টাকার বেশি রেমিট্যান্স পাঠালে গেল বছরের ডিসেম্বরে বাড়তি এক শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া শুরু করেছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস কোম্পানি বিকাশ।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে পাঠানো চিঠিতে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছেন, মহামারী করোনার মধ্যেও প্রবাসী আয় রেমিট্যান্স পাঠানো সচল রয়েছে। চলতি বছর প্রবাসী আয় ৩৫ শতাংশ বাড়তে পারে। আগামী বছর বাড়বে আরও ২০ শতাংশ। করোনার প্রভাব কেটে গেলে হুন্ডিতে লেনদেন বাড়তে পারে। এতে রেমিট্যান্সের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। এসব কিছু বিবেচনা করে রেমিট্যান্সের প্রণোদনা দুই শতাংশ বৃদ্ধি করে চার শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন ইমরান আহমদ।
উন্নত দেশগুলো থেকে প্রবাসী আয় বাড়ছে দ্রুত : যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশির সংখ্যা সব মিলিয়ে ২ লাখের কিছু বেশি। দেশটিতে মহামারীর তীব্রতা কিছুটা কমলেও স্বাভাবিক ছন্দে ফেরেনি জীবনযাত্রা। দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের নিয়ে আশঙ্কার জায়গা অনেক। কিন্তু এর বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাপকমাত্রায় বেড়েছে। এক বছর আগেও দেশে রেমিট্যান্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। কিন্তু কভিড সংক্রমণের এক বছরে দেশটিকে হটিয়ে সে অবস্থানে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ৮৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। যদিও ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে এর পরিমাণ ছিল ৪৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এ হিসাবে গত দুই অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২৪৯ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে দেশটি থেকে ১৭১ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। অন্যদিকে কভিড প্রাদুর্ভাবের আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল মাত্র ১৩৩ কোটি ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও করোনাকালে যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশ থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যদিও এ দেশগুলো থেকে হঠাৎ করে রেমিট্যান্সে এত বেশি প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা নয় বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোয় বাংলাদেশিরা পরিবারসহ স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকে বাংলাদেশ থেকে নিজেদের বাড়িঘর বিক্রি করে ওই সব দেশে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় হঠাৎ করে যদি যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য থেকে রেমিট্যান্স অনেক বেশি বেড়ে যায়, সেটি অস্বাভাবিক। এ উল্লম্ফন প্রকৃত প্রবৃদ্ধি কিনা, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। তবে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে ফিরে এলে আমাদের আপত্তি নেই। পাচারকৃত অর্থ দেশের অর্থনীতিতে আবর্তন হলে সেটি মঙ্গলজনক। শর্ত হলো দেশে আসা অর্থ দেশে থাকতে হবে। এক দিক থেকে এসে অন্যদিক দিয়ে আবার চলে গেলে তাতে ক্ষতি ছাড়া কোনো কল্যাণ নেই।
করোনাকালে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা : এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলামের ভাষ্য হলো, তিন-চার বছর আগের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে টাকা পাঠানো সহজ হয়েছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে টাকা পাঠাতে ব্যাংকে গিয়ে আমি খুব সহজেই পাঠাতে পেরেছিলাম।
মহামারীতে দেশে স্বজনদের কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশি আমেরিকানরা আগের তুলনায় বেশি অর্থ পাঠাতে পারেন। তবে সেটি এত বেশি কীভাবে হলো, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
দেশের ব্যাংক ও শেয়ারবাজার থেকে লুট হওয়া অর্থের একটি অংশও রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে ফিরতে পারে বলে ধারণা সাবেক এ রাষ্ট্রদূতের। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে প্রবাসীদের আয় বেড়ে গিয়েছে, এমন সংবাদ আমরা শুনিনি। বরং মধ্যপ্রাচ্য থেকে যেসব প্রবাসী চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরেছেন, তারা শূন্য হাতেই ফিরেছেন। লকডাউনসহ নানা কারণে বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এ অবস্থায় ১০ মাসে ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসা অস্বাভাবিক। দেশের ব্যাংক ও শেয়ারবাজার থেকে লুট হওয়া অর্থের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত দেশগুলো। এখন সেসব লুটের টাকা রেমিট্যান্স হিসেবে হোয়াইট মানিতে রূপান্তর হয়ে থাকতে পারে।
যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হয় বলে মনে করেন অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার। তিনি বলেন, চলমান মহামারীতে দেশে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে। উদ্যোক্তাদের অনেকেই ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থায় পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই প্রবাসীরা আগের চেয়ে বেশি অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন বলে মনে হয়। তবে ব্যতিক্রম ঘটনাও থাকতে পারে। এটি সত্য যে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিরা সে সমাজের অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে আছেন। আবার যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোতে অনেকেই পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এ কারণে দেশের সঙ্গে অনেক বাংলাদেশির সম্পর্ক খুবই কম।