সেখানে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ ছাড়াও ২০ জাতের কাঁকড়া, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি ও ৩৬০ প্রজাতির শামুক ঝিনুকের সন্ধান পাওয়া গেছে। টুনার মতো দামি ও সুস্বাদু মাছ রয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে যার চাহিদা প্রচুর। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের (পিসিএ) রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি সমুদ্র এলাকায় দখল পায় বাংলাদেশ।

এর পরই কখনো ধীরে কখনো দ্রুতগতিতে সুনীল অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমির চূড়ান্ত অর্জনের জন্য কাজ করতে থাকে বাংলাদেশ সরকার। মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় নতুন সমুদ্র সীমা অর্জনের দুই বছর পর ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্র সীমানার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গ কিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এরপর জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৭ সালে ‘ব্লু ইকোনমি সেল’ গঠন সমুদ্রসম্পদ সুরক্ষায় ২০১৯ সালে মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমুদ্রসীমা বিজয়ের ফলে ব্লু ইকোনমির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দুই ধরনের সম্পদ অর্জন করেছে। এর একটি হলো প্রাণিজ আরেকটি অপ্রাণিজ। প্রাণিজের মধ্যে রয়েছে মৎস্যসম্পদ, জলজ প্রাণী আগাছা গুল্মলতা ইত্যাদি। অপ্রাণীজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে খনিজ ও খনিজ জাতীয় সম্পদ যেমন তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি। আরও রয়েছে ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজ বালু। যেমন জিরকন, রোটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিক্লোসিন ইত্যাদি। যার মধ্যে মোনাজাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সূত্রমতে, সমুদ্রে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের মালিক এখন বাংলাদেশ। সমুদ্র অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে এ সমুদ্র অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বিত কাজ করা উচিত। কেউ কেউ এ সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগাতে ‘সমুদ্রসম্পদ মন্ত্রণালয়’ নামে আলাদা একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করারও পরামর্শ দেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ আছে তার প্রায় সমপরিমাণ (৮১ শতাংশ) সম্পদ সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে। সমুদ্রের তলদেশে যে সম্পদ রয়েছে তা টেকসই উন্নয়নের জন্য সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। তেল গ্যাসসহ মূল্যবান সম্পদ উত্তোলন, মৎস্যসম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা মাফিক কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। অপার সম্ভাবনায় এ খাতকে কাজে লাগানো জরুরি।

জানা যায়, তেল গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ১৩ জায়গায় সোনার চেয়ে অধিক মূল্যবান বালু অর্থাৎ ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম রয়েছে যাতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গানেট, সেলিমেনাইট, জিরকন রুনটাইল ও ম্যাগনেটাইট। এ ছাড়া সমুদ্রের গভীরে জমে আছে কাদা যা দিয়ে তৈরি হয় সিমেন্ট। বঙ্গোপসাগরের নিচে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি তেল ও গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। এ ছাড়া প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ন্যূনতম ১.২৪ মিলিয়ন টন খনিজ বালুর সমাহার রয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্রোপকূলে। সেখানে প্রায় ১৭ প্রকার খনিজ বালুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ইলমেনাইট, জিরকন, রুনটাইল ম্যাগনেটাইট, লিউকোক্সিন, কিয়ানাইট, মোনাজাইট দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে সক্ষমতা রাখতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমুদ্রসৈকতের বালুতে মোট খনিজের মজুদ ৪৪ লাখ টন। প্রকৃত সমৃদ্ধ খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন। ২০১৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসির সঙ্গে দুটি অগভীর ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি রয়েছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোসের সঙ্গে গভীর ব্লক ১১ ও দক্ষিণ কোরিয়ার পোস্কো-দাইয়ুর সঙ্গে গভীর ব্লক ১২ এ চুক্তি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘ব্লু ইকোনমি’র সাফল্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগাতে আমরা বেশকিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এর মধ্যে রয়েছে নৌযান কেনা, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মৎস্য ও সমুদ্রসম্পদ আহরণে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজনের প্রস্তুতি। আগামী ছয় মাসের মধ্যে দৃশ্যমান কর্মযজ্ঞ শুরু হবে।’

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে চার বছর ধরে আমরা গবেষণা করছি। আমরা দেশের সব উপকূলীয় এলাকায় শৈবাল নিয়ে কাজ করব। ইতিমধ্যে পটুয়াখালীতে একটি গবেষণা ল্যাব বসানো হয়েছে। সামুদ্রিক শৈবাল চাষ ও আহরণে দক্ষ করে তুলতে কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় ৩২০ চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।’