প্রবাসী আয় হ্রাস-বৃদ্ধি দুশ্চিন্তায় সরকার
জাফর আহমদ
🕐 ১০:১৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৮
প্রবাসী আয় (রেমিটেন্স) নিয়ে পুরোপুরি ভাবনামুক্ত হতে পারছে না সরকার। কোনো মাসে আয় বৃদ্ধি পেলে পরের মাসে কমছে। আবার রেমিটেন্স বাড়বে না কমবে সেটাও অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যেই থাকছে। ফলে রিজার্ভ (বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন) একটি সম্মানজনক পরিমাণ ধরে রাখার পাশাপাশি বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের যে লক্ষ্যমাত্রা তা মার খাচ্ছে।
রেমিটেন্স প্রবাহের বিষয়টি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হলেও বাংলাদেশের উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। এসব মুদ্রার প্রধান অবলম্বন হচ্ছে প্রবাসী আয়, বৈদেশিক ঋণ আর রপ্তানি আয়। রেমিটেন্সের প্রধান উৎস প্রবাসী আয়। পরের দুটির মধ্যে অন্যতম হলো রপ্তানি আয়। এই রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ ভাগ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তৈরি পোশাক রপ্তানি করে যে আয় হয় তার ৬০ ভাগ বিদেশে চলে যায় কাঁচামাল আমদানি করতে। বৈদেশিক ঋণ আবার সুদেআসলে পরিশোধ করতে হয়। ফলে বৈদেশিক ঋণ বৈদেশিক মুদ্রার যতটা উৎস তার চেয়ে বেশি বোঝা। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো আয় বা রেমিটেন্স। এ কারণে রেমিটেন্সের ব্যাপারে সরকার বেশি মনোযোগী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে রেমিটেন্স বৃদ্ধির একটি ইতিবাচক গতি তৈরি হয়েছে যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এসে থমকে যায়। তথ্যে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৭৬০ দশমিক ১১ বিলিয়ন টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৮২৯ দশমিক ৯১ বিলিয়ন টাকা; ২০১১-১২ অর্থবছরে ১০১৮ দশমিক ৮২ বিলিয়ন টাকা; ২০১২-১৩তে ১১৫৬ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন টাকা; ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১১০৫ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন টাকা; ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১১৮৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন টাকা, ২০১৫-১৬তে ১১৬৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিটেন্স কমে দাঁড়ায় ১০১০ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন টাকা। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় সরকারের টনক নড়ে। ওই বছর রপ্তানি ব্যয় মিটানোর পর যখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায় তখন সরকার রেমিটেন্স বাড়ানোর উপায় খুঁজতে থাকে। রেমিটেন্স বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা রকম উদ্যোগের ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই বিলিয়ন টাকা বেড়ে যায়। এ সময় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণ রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মাসগুলোতেও রেমিটেন্স প্রবাহের আনুপাতিক হার ঠিক ছিল। কিন্তু এ হার প্রবৃদ্ধির কোনো ইঙ্গিত বহন করে না। এতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কপালে ভাঁজ পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, রেমিটেন্স আসার স্বাভাবিক হার পতনের কোনো কারণ নেই। কিন্তু সমস্যা করছে হুন্ডি। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স আনা গেলে রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে যাবে। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে ডলার সংগ্রহ করে বিদেশেই রেখে দিচ্ছে। আর দেশ থেকে টাকা শোধ করছে। ফলে প্রবাসী শ্রমিকরা রোজগার করলেও তাদের শ্রমের দাম দেশে আসছে না। দেশের টাকা দিয়েই প্রবাসী শ্রমিকদের পাওনা শোধ করছে। আর ডলারগুলো বিদেশে রেখে দিচ্ছে। এতে ব্যক্তির লাভ-লোকসান না হলেও দেশের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এসব রেমিটেন্স ব্যাংকিং চ্যানেলে এলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করে টাকা নিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারকে পরিশোধ করত। আর ডলারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে জমা হতো যা দিয়ে সরকার আমদানি ব্যয় নির্বাহ করে।
সাধারণত তিন মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহের সমান বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থাকলেই চলে। তবে বেশি রিজার্ভ থাকলে তা কোনো দেশের অর্থনীতির সক্ষমতার অন্যতম প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। বিদেশি ঋণনির্ভর উন্নয়ন করা দেশগুলোর জন্য এই রিজার্ভ আরও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন কমে গেলে তা বৈদেশিক সাহায্যও পরিশোধ করা কঠিন হয়ে যায়। এ কারণে রেমিটেন্স কমে যাওয়ায় সরকারের টনক নড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত রিজার্ভের পরিমাণ হলো ৩২ দশমিক ৯২৬ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এপ্রিল মাসে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। ছয় মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ কমে গেছে। এ জন্যই সরকার যে কোনোভাবেই হোক রেমিটেন্স প্রবাহের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে চায়।