ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ইনক্রিমেন্ট স্থগিতের প্রস্তাবে অস্বস্তি

জাফর আহমদ
🕐 ৯:২৮ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০

ইনক্রিমেন্ট স্থগিতের প্রস্তাবে অস্বস্তি

তৈরি পোশাক কারখানা শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট (বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি) স্থগিত রাখার আবেদন জানিয়েছে এ খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। ফলে পোশাক খাতে বিশেষ করে শ্রমিকদের মাঝে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। শ্রম প্রতিমন্ত্রীকে দেওয়া প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতিতে পোশাক খাতে বড় ধরনের আঘাত এসেছে। এ অবস্থায় এ বছরের জন্য নির্ধারিত ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়া সম্ভব নয়। তবে শ্রমিক নেতারা বলছেন, করোনা মহামারীর মধ্যে শ্রমিকরা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে উৎপাদন সচল রেখেছেন। সেই শ্রমিকদের ঝুঁকিভাতা দেওয়া প্রয়োজন ছিল। তা না দিয়ে ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করার আবেদন করে মালিকরা অমানবিক ও নীতিহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।

মজুরি বোর্ডের ঘোষণা অনুযায়ী, প্রতিবছরে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সংগতি রেখে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার বিধান রয়েছে। ২০১৭ সালে মালিক পক্ষ, শ্রমিক পক্ষ ও নিরপেক্ষ সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত মজুরি বোর্ড এ প্রস্তাব অনুমোদন করে। সরকার এতে সম্মতির দেওয়ায় এটা আইনে পরিনত হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী ২০১৮ সালে শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়। এ বছর করোনা মহামারীর কারণে তৈরি পোশাক শিল্পে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া ও রপ্তানি বাতিল হওয়াসহ প্রতিকূল অবস্থার কারণে তৈরি পোশাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অভিঘাত মোকাবিলায় শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য সরকার বিনা সুদে ঋণ, ভর্তুকি সুদে ঋণ সহায়তা এবং ব্যাংকের টাকা জমা দিতে প্রায় এক বছর সময়-সুবিধা দেয়।

উদ্যোক্তারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতির পর চলতি ২০২০ সালের জন্য নির্ধারিত ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য চলতি ও আগামী বছরের জন্য ইনক্রিমেন্ট স্থগিত রাখা প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে নিট খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিকেএমইএ শ্রম প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে। বিকেএমইএ-এর চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ক্রেতারা পোশাকের দাম ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত কম দিচ্ছেন। লোকসান দিয়ে ক্রয়াদেশ নিতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। তারপরও বেতন কমানো হয়নি। ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমান অবস্থায় ইনক্রিমেন্ট দেওয়াটা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। সদস্যরা চেয়েছেন বলেই আবেদন করা হয়েছে। ওভেন তৈরি পোশাক শিল্পখাতের সংগঠন বিজিএমএইএ মৌখিকভাবে জানিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সচিবকে।

ইনক্রিমেন্ট না হওয়ার খবর ইতোমধ্যে শ্রমিকদের মধ্যে পৌঁছেছে। তবে ইনক্রিমেন্ট হবে না- এমন খবর তারা বিশ্বাস করতে চান না। কারখানা থেকেও এ ব্যাপারে জানানো হয়নি। তারা মনে করেন মালিক ইনক্রিমেন্ট দেবেন। ২০২০ সালের মহামারীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। ইনক্রিমেন্ট না পেলে জীবনযাত্রার এই ব্যয় সামাল দিতে পারবেন না শ্রমিকরা।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপাতত কোনো সমস্যা না হলেও আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে যখন বাড়তি মজুরি পাবেন না, তখন শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারেন। এ বিষয়ে মিরপুরের একটি কারখানার অপারেটর ইয়াসমিন খাতুন খোলা কাগজকে বলেন, আমরা সবাই আশা করে বসে আছি বেতন (ইনক্রিমেন্ট) বাড়বে; আগামী মাসের ১০ তারিখে বেতনের সঙ্গে বাড়তি টাকা পাব। বেতন না বাড়লে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। এ বছর চালের দাম বেড়েছে, তেলের দাম বেড়েছে; বাড়িভাড়া বেড়েছে। ইনক্রিমেন্ট না পেলে বাড়তি খরচ কিভাবে দেবো।

উদ্যোক্তাদের এ ধরনের প্রস্তাবে পোশাক শ্রমিকদের মাঝে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু। করোনা মহামারীর মধ্যে উৎপাদন অব্যাহত রাখায় তৈরি পোশাক শ্রমিকদের সম্মুখ যোদ্ধা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করার চিঠি মালিকদের শিশুসুলভ প্রস্তাব হয়েছে।

তিনি খোলা কাগজকে বলেন, এ বছর মূল্যস্ফীতি হয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। তার মানে হলো আগের বছরের চেয়ে ৬ শতাংশ হারে পণ্যের দাম বেড়েছে। একই বেতনে গতবারের চেয়ে ৬ শতাংশ হারে পণ্য ও সেবা কমে গেছে। আইন অনুযায়ী এই ডিসেম্বর মাসে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দিলেও আগের বছরের চেয়ে ১ শতাংশ হারে কম থাকবে। করোনা ও মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে, শ্রমিকদের কষ্টের কথা বিবেচনা করে মজুরি আরও বেশি হারে বাড়ানোর উচিত ছিল। কিন্তু তারা উল্টো ইন্টক্রিমেন্ট না দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। এটা পুরোপুরি অমানবিক, অনৈতিক ও বেআইনি। আশা করি, মালিকরা এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন। সরকারকেও বলবো মালিকদের বেআইনি আবদার বাস্তবায়নে যেন সম্মতি না দেয়।

এ ধরণের প্রস্তাবকে তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিরতা তৈরি করে সুবিধা আদায়ের উপায় হিসাবে মনে করেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান ইসমাইল। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, ‘এটি একটি নীতিহীন সুুযোগ নেওয়ার পাঁয়তারা। করোনা মহামারীর কারণে মানুষ যখন বিপন্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে; করোনায় বিশ^ পরিস্থিতিতে এক দেশ আরেক দেশের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে। আর তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা করোনার সুযোগ নিয়ে নীতিহীনভাবে শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করতে চান।’

তিনি বলেন, ইনক্রিমেন্ট হলো শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি- যা ওয়েজ বোর্ড দ্বারা স্বীকৃত ও স্বাক্ষরিত। যাতে সরকারের সম্মতি আছে; গেজেট প্রকাশের মধ্য দিয়ে এটা আইনে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোনো মালিক এটাকে অস্বীকার করতে পারেন না। এই আইন পরিবর্তন বা স্থগিত করতে পারেন আদালত এবং যদি যৌক্তিক ও সংগত ক্ষেত্র থাকে।

মূলত তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের দিয়ে অস্থিরতা তৈরি করে সুযোগ নেওয়ার জন্যই এ ধরনের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে মনে করেন এই শ্রমিক নেতারা।

 
Electronic Paper