ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বিথীর উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প

বিবি ফাতেমা খাতুন
🕐 ২:৫১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৯, ২০২০

বিথীর উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প

সবার সফলতার পেছনেই লুকিয়ে থাকে ছোট বড় গল্প। সেই গল্পগুলো কখনও থাকে আনন্দে ভরপুর আবার কখনও থাকে অনেক কষ্ট আর পরিশ্রমের আদলে মোড়ানো। নতুন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু হয় না। কেউ হয়তো একটু সহজে সফলতা পায় আবার কাউকে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে সফলতার মুখ দেখতে হয়। জীবনের বৈচিত্র এখানেই। সবার জীবন আলাদা, সবার গল্প আলাদা আবার সব গল্প কোথায় যেনো এক সূত্রে গাঁথা।

সাহারা আখতার বিথী একজন উদ্যোক্তা। বলেছেন, তার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প। গল্পের শুরুতেই তিনি বলে নিয়েছেন যে, পারসোনাল ব্র্যান্ডিং তৈরি করতেই আজকে হাজির হয়েছি এখানে, কারণ আমার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প যদি নাই জানেন তাহলে চিনবেন কিভাবে। তাছাড়া আমরা নারীরা কিভাবে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে উদ্যোক্তা হই তাও তো জানতে হবে কারণ অন্য কেউ আমার গল্প পড়ে উদ্যোক্তা হতে সাহস দেখাবে।

এরপর তার গল্প আর অভিজ্ঞতা শুরু করলেন এভাবে- আমার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পটা একটু ব্যাতিক্রমী। উদ্যোক্তা কি আমি  জানতামই না। ছোটবেলা থেকে হাতের কাজের জিনিসের প্রতি খুব ঝোঁক ছিল আমার। ২০০৪ সালে এসএসসি পরীক্ষার পরে কিছুটা সময় পাওয়ায় ভর্তি হয়ে গেলাম মহিলা অধিদপ্তরের টেইলারিং কোর্সে। নিজের জামা কাপড় নিজেই বানাবো- এমন উদ্দেশ্য ছিল। কিছুটা ফ্যাশন সচেতন হওয়ায় গজ কাপড় কিনে নিজের মতো করে ডিজাইন তৈরি করে নিজের জামা নিজেই বানাতাম। সবাই দেখে ভালো বলায়, আরো বানানোর ইচ্ছে তৈরি হতো নিজের মধ্যে ।

আমার মা হাতের নকশী সেলাইয়ে খুব পারদর্শী ছিলেন। সুন্দর সুন্দর নকশীকাঁথা সেলাই করতেন তিনি। এগুলা দেখে বড় হয়েছি আমি। একটু ভিন্নতা আনার জন্য আমার জামায় আমি এই নকশীকাঁথার ডিজাইন করা শুরু করি শুধু নিজে পরার জন্য।

২০০৬ সালে আমার বিয়ে হয়। অনার্সে আমার কলেজ বাবার বাড়ির কছে হওয়ায় বেশির ভাগ সময় বাবার বাড়িতেই থাকতাম। সংসার রান্না কিছুই করতাম না। কিন্তু সব কিছু অনুসরণ করতাম। সখের বশে মাঝে মাঝে আচার তৈরি করে স্বামীকে পাঠাতাম কারণ তিনি আচার পছন্দ করতেন।

২০১২ সালে অনার্স শেষ হয় আমার। এর মধ্যে আমার বড় ছেলে শাহরিয়া খান সাফোয়ানের জন্ম হয়। স্বামী বিমান বাহিনীতে চাকরি করেন তাই তার সাথে ঢাকায় চলে আসি সংসার করার জন্য। শুরু হলো পুরোদস্তুর গৃহিণী হিসেবে কাজ। বাচ্চা, সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত আমি। এর মাঝে আমার ছোট ভাই আমাদের ছবি দেখার জন্য ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিল। শুরু হলো আমার অনলাইন যাএা।

ফেসবুকে ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলাম বিজনেস আইডিয়া। শুরু করবো যখন ঠিকঠাক তখন আমার ছোট ছেলে সেজাদ খান সাদাফ ২০১৭ সালে জন্ম নিলো। বিজনেস আর শুরু করা হলো না। কিন্তু মনের মধ্যে সারাদিন ঘুরপাক খেতো এই চিন্তা। স্বামীর সাথে যখন এই চিন্তা নিয়ে আলোচনা করি, প্রথমে তিনি রাজি হলেন না। তিনি তার চাকরির ব্যস্ততার কথা বলে আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেন।

তখন ঢাকার তেমন কিছুই চিনি না, পুরোপুরি একজন গৃহিণী আমি। ঘরে বিভিন্ন ধরনের আচার তৈরি করতাম, আমার খালাতো ভাইয়ের সাহায্যে পেইজ খুললাম। ঘরের তৈরি আচারের ছবি দিয়ে শুরু হলো আমার ই-কমার্স বিজনেস।

প্রথম যেদিন পেইজে পোস্ট দেই ঠিক তার পরের দিন একটা অর্ডার আসে। আমি তো মহাখুশি, যা আমি বলে বা লিখে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু মনের মধ্যে বিশাল চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে যে অর্ডারের আচার কীভাবে পৌঁছে দেবো। অর্ডার কনফার্ম করেছি, তাই পৌঁছে দিতে হবেই। শুরু হল স্বামীর কাছে অনুনয় করা। তিনি কিছুতেই রাজি নন। দুই দিন ঝগড়া, আমার মায়ের কাছে নালিশ দিলেন । আমিও খুব জেদি। সরাসরি বলে দিলাম, প্রয়োজনে তোমার সংসার ছাড়বো তবুও বিজনেস করবো।

কী ভেবে বলেছি নিজেও জানি না। লোকটা মনে হয় আমাকে বেশি ভালোবাসেন তাই আমার জেদ মেনে নিলেন। সেই আচার অনিচ্ছা থাকা সত্বেও তিনি লোক দিয়ে ডেলিভারির ব্যবস্থা করলেন। শুরু হল যাএা।

Bithe creations - এটা আমার পেইজ এর নাম। আমার প্রথম ভালোবাসা। প্রথম অর্ডার এর পরে টুকটাক ভালোই অর্ডার পেয়েছি আর ডেলিভারিও দিয়েছি। এর মধ্যে আমার বড়ো ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করালাম, শুরু হল বাইরে বের হওয়া। বাইরের জগত চিনতে শুরু করলাম। জামা কাপড়ের প্রতি আগ্রহ থাকায় ছেলেকে স্কুলে দিয়ে বিভিন্ন গজ কাপড়ের দোকানে ঘুরতাম। কিনে কিনে নিজের জন্য বানাতাম।

আচার- এর পেইজ থেকে যে ইনকাম হতো তা দিয়ে অল্প কিছু টাকা নিয়ে কাপড় কিনে ১২ টা থ্রি পিস রেডি করলাম সাথে নকশীকাঁথা, বিছানার চাদর নকশী করে নিজেই সেলাই করা শুরু করলাম। তখন ‘বীথি বুটিকস’ নামে আর একটি পেইজ খুলে তাতে নিজের বানানো পণ্যগুলো প্রদর্শন করলাম। দুই একটা বিক্রি হলো। কিন্তু হাতের কাজের জিনিসের চাহিদা দেখলাম বেশি। তাই কর্মী খোঁজা শুরু করলাম।

 আমি যেখানে থাকি সেখানে কর্মী বেশি একটা পাওয়া যায় না, তবুও ছেলের স্কুলে গিয়ে সবার সাথে আলোচনা করতাম। পরে খুঁজে পেলাম কয়েক জনকে আর শুরু হলো আমার বুটিকস যাএা। হাতের কাজের পণ্যের প্রি অর্ডার বেশি। এর মধ্যে আমার নিজস্ব ডিজাইনের কিছু বুটিক থ্রি পিস একজন থ্রি পিস বিক্রেতার পছন্দ হলো। তিনি প্রথমে একট থ্রি পিছ নিলেন। পণ্যের মান ভালো দেখে পরে পাইকারি রেটে ১২ টা থ্রি পিসের অর্ডার দিলেন। এটাই ছিল তখনকার সময়ে আমার বুটিকস-এর সবচেয়ে বড় অর্ডার।

এখন আমার বুটিকস-এ ২১ জন কর্মী কাজ করেন। আমি এখনো বাসায় বসে বিজনেস পরিচালনা করি। আমার কোন শো রুম নেই। হয়তোবা, আমার ই-কমার্স বিজনেস শিশু পর্যায়ে আছে। তবে অনেক দূর যাওয়ার ইচ্ছা আছে।

 নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য টিপস হিসেবে এটুকু বলতে পারি কেউ যদি দেশি পণ্যের উদ্যোক্তা হতে চান তবে কখনো পূঁজি নেই- এমনটা ভেবে থেমে যাবেন না। দেশী পণ্যের উদ্যোক্তা হতে পূঁজি লাগে না, তার প্রমান আমি নিজেই।

 

 
Electronic Paper