ব্যাংকের সুদ বাড়াচ্ছে ঊর্ধ্বতনদের উচ্চ বেতন
জাফর আহমদ
🕐 ১০:৩৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০১৮
চলতি জুলাই মাসের এক তারিখ থেকে ঋণ বিতরণে সুদ হার এক অংকে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ আছে। ব্যাংক উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠান বিএবিও এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংক এ ব্যাপারে কার্যক্রর করতে পারেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন- সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রকার সুবিধা দেওয়া হলেও বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের উচ্চ বেতন-ভাতা ও ব্যাংক শাখার ডেকোরেশনে উচ্চ খরচ অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের অত্যাধিক মাত্রার এ বাড়তি বেতন কোনোভাবেই কাম্য নয় বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম। খোলা কাগজকে তিনি বলেন, এমডিদের বেতন কমাতে প্রয়োজনে সরকার আইন করতে পারে। বিদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে। তিনি বলেন, সুদে প্রভাব ফেলার এটি অন্যতম কারণে বলে উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের মাসিক বেতনভাতা বাবদ মাসে ৮ থেকে ১৮ লাখ টাকা দিতে হয়। এক-একটি শাখা প্রতিষ্ঠা ও এসব শাখার খরচ নির্বাহেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে গুনতে হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। যা সাধারণ খরচের চেয়ে ১০ থেকে ব্যাংক ভেদে ২০ গুন বেশি। আর এসব খরচ ব্যাংকের গ্রাহকদের কাছ থেকে তুলে নেওয়া হয়।
প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ২০১৭ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী এসব ব্যাংকের নির্বাহীদের মধ্যে সর্বোচ্চ বেতনভাতা পেয়েছেন ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলী রেজা ইফতেখার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেতনভাতা পেয়েছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ও সিইও আনিস এ খান। বছরটিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ বেতনধারী শীর্ষ ব্যাংক নির্বাহী দ্য সিটি ব্যাংকের এমডি ও সিইও সোহেল আরকে হোসেন। গত বছর ব্যাংকের শীর্ষ ১০ বেতনধারী অন্য প্রধান নির্বাহীরা হলেন যথাক্রমে, এনআরবি ব্যাংকের মো. মেহমুদ হোসেন, এক্সিম ব্যাংকের ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের কাজী মসিহুর রহমান, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের মো. হাবিবুর রহমান, আইএফআইসি ব্যাংকের শাহ আলম সারওয়ার, যমুনা ব্যাংকের শফিকুল আলম ও ওয়ান ব্যাংকের এম ফখরুল আলম।
২০১৭ সালে ইস্টার্ন ব্যাংক আলী রেজা ইফতেখার প্রতি মাসে গড়ে পেয়েছেন ১৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক আনিস এ খান প্রতি মাসে পেয়েছেন ১৫ লাখ ২৩ হাজার টাকার আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন। সিটি ব্যাংকের এমডি সোহেল আরকে হোসেন প্রতি মাসে পরিশোধ করতে হয়েছে ১৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। অন্যান্য বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এমডিদের বেতন সুবিধাদি মিলে প্রতি মাসে ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সাজসজ্জা ও খরচ নির্বাহ বাবদের বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। সম্প্রতি আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যাংকিং খাতের জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠার কারণে। সফ্টওয়্যার, এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং জনবলের জন্যও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, এ খরচের অর্ধেক কমিয়েও শাখা পরিচালনা করা সম্ভব। কিন্তু বাড়তি খরচ করে ব্যাংক শাখাগুলো পরিচালনা করে। যার প্রভাব পড়ে ঋণ বিতরণে সুদ হারের ওপর।
ব্যাংকগুলোর ‘অনহেলথি কম্পিটিশন’ প্রধান নির্বাহীদের বেতন বৃদ্ধি হওয়া অন্যতম কারণ বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। খোলা কাগজকে তিনি বলেন, তুলনামূলক কম দক্ষ এমডি কিন্তু ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। ভালো এমডিকে পাওয়ার জন্য ব্যাংকের উদ্যোক্তারা বেশি বেতন দিয়ে থাকে। এতে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয়ের ওপর প্রভাব পড়ে। এটি আরও বড় হয়ে চোখে পড়ার কারণ হলো এসব ব্যাংকের সম্পদ ও মূলধন ব্যাংকের আকারের বিবেচনায় ব্যাংকগুলো খুবই ছোট্ট হওয়ার কারণে। তাদের যে বেতনভাতাই দেওয়া হোক তার প্রভাব পড়ে মোট খরচে। ব্যাংকগুলো বড় হলে এসব বিষয় চোখে পড়ত না। বা পরিচালন ব্যয়েও প্রভাব পড়ত না। সরকারে বেশি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার মধ্য দিয়ে পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রও তৈরি করে দিয়েছে। আর সুদ নির্ধারণে এর প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন এ গবেষক। পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধানদের সৎ থাকার যে প্রত্যাশা ও চাকরি শেষে সামাজিক নিরাপত্তার যে বিষয়টি আছে তা বিবেচনায় নিলে বেতন বৃদ্ধির যৌক্তিক বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সেবা দিচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তথ্য অনুযায়ী এসব সফ্টওয়্যার কিনতে ২০ থেকে ধরন ভেদে ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। পরিচালনা, নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। এ জন্যও ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। এ খরচ তুলে নিতে সুদে প্রভাব পড়ছে। এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলো বড় হলে সংখ্যায় কমত। ফলে ১০টি সফটওয়ার না কিনে বা ১০ গুণ জনবলের বাড়তি খরচ না করে একটি সফটওয়্যার বা কম জনবলেই ব্যাংক চলত। এতে সুদ হার কিছুটা কমানো যেত।