ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ক্রিসেন্ট লেদারের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত

প্রমাণ মিলেছে অর্থপাচারের

সাজেদুর রহমান
🕐 ১০:৪৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৩, ২০১৮

রপ্তানির নামে অর্থপাচার করেছে ক্রিসেন্ট লেদার। কাগজপত্রের প্রাথমিক পর্যালোচনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে বিষয়টি প্রতীয়মান হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, রপ্তানির বিপরীতে অর্থ না আসায় তা পাচার হয়েছে ধরে নিয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ অনুযায়ী এ তদন্ত হবে।

বেশকিছু তথ্য-উপাত্ত এরই মধ্যে সংগ্রহ করেছে অধিদপ্তর। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানির নামে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করেছে।
এনবিআর সূত্র থেকে জানা গেছে, গত বুধবার এনবিআরের এক সভায় ক্রিসেন্ট লেদারের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের আলোকে গত বৃহস্পতিবার থেকে ক্রিসেন্ট লেদারের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্তে নেমেছেন শুল্ক গোয়েন্দারা।
জানা গেছে, তদন্তের অংশ হিসেবে ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণ, বিদেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বিল অব এন্ট্রি (বিই), রপ্তানি আদেশ ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় প্রাথমিকভাবে অর্থপাচারের প্রমাণও পেয়েছে অনুসন্ধান কমিটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শতাধিক ব্যক্তিকে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরে ডাকার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কাস্টমসের কর্মকর্তারাও রয়েছেন।
শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে খোলা কাগজকে জানান, মূলত, রপ্তানি তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে কাস্টমস কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন শুল্ক গোয়েন্দারা। পাশাপাশি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আদেশ, পণ্য গ্রহণের তথ্য ও অর্থ পরিশোধ না করার কারণ জানতে সংশ্লিষ্ট দেশে এজেন্ট নিয়োগ দেওয়ার বিষয়েও চিন্তাভাবনা করছেন তারা।
জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানার জনতা ব্যাংক থেকে ঋণের নামে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ক্রিসেন্ট লেদার। প্রধান কার্যালয় ও শাখা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যাংকের পুরান ঢাকার ইমামগঞ্জ শাখা থেকে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ব্যাংকের একক গ্রাহকের ঋণসীমার তিনগুণ ঋণ দেওয়া হয়েছে ক্রিসেন্ট লেদারকে। চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির নামে বিভিন্ন উপায়ে বিপুল অঙ্কের এ ঋণ নেওয়া হলেও আদৌ রপ্তানি হয়েছে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অনিয়মের সঙ্গে জনতা ব্যাংকের বর্তমান এমডি, ডিএমডিসহ অন্তত ১০ কর্মকর্তা জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্রিসেন্ট লেদারের চেয়ারম্যান এম এ কাদের চামড়া খাতের অন্যতম ব্যবসায়ী।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ক্রিসেন্ট লেদারের মালিকানাধীন ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্ট, রূপালী কম্পোজিট লেদার ওয়্যারস, ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ, রিমেক্স ফুটওয়্যার এবং লেক্সকো লিমিটেড নামের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান থেকে চীন, ইতালি, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি দেখানো হয়। এসব রপ্তানির বিপরীতে সৃষ্ট ফরেন ডকুমেন্টারি বিল ক্রয় (এফডিবিপি) করে জনতা ব্যাংক। গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শনে নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে এফডিবিপির বিপরীতে এক হাজার ১৩৫ কোটি টাকা দেওয়ার তথ্য উঠে আসে। রপ্তানির ১২০ দিনের মধ্যে এসব বিলের অর্থ ফেরত আনার নিয়ম থাকলেও ক্রিসেন্টের ক্ষেত্রে তা আসেনি।
জানা গেছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে ধারাবাহিকভাবে রপ্তানির অর্থ না এলেও বিল কেনা বন্ধ করেনি ব্যাংক। এভাবে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৫৭০টি বিল কিনেছে জনতা ব্যাংক। এ তথ্য উদ্ঘাটনের পর নতুন করে কোনো বিল না কেনার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে পুরনো দায় সমন্বয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পরও চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে ১৭২টি বিলের বিপরীতে ক্রিসেন্ট লেদারকে ৩৪৩ কোটি ১১ লাখ টাকা দেয় ব্যাংক। এই অর্থ থেকে ১৪৭ কোটি টাকার দায় সমন্বয় করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেখানো হয় ওই পরিমাণ রপ্তানির অর্থ দেশে এসেছে। পরে বিভিন্ন তথ্য বিশ্নেষণ করে ব্যাংকের দেওয়া তথ্য সঠিক নয় বলে জানতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. শহিদুল ইসলাম খোলা কাগজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে আমরা তদন্তের কাজ শুরু করেছি। এরই মধ্যে রপ্তানি-সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন শুল্ক গোয়েন্দারা। কাগজপত্রের প্রাথমিক পর্যালোচনায় রপ্তানির নামে অর্থপাচার হয়েছে বলে এনবিআরের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি ও পক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ চিত্র পরিষ্কার হবে। তিনি আরও জানান, একটা বিষয়ে বলা রাখা ভালো, এই অর্থপাচারের সঙ্গে ৫টা দেশের প্রায় ডজন খানেক প্রতিষ্ঠান জড়িত আছে। এসব বিদেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকায় তদন্ত কাজ তাড়াতাড়ি করা সম্ভব নয়। দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে।
এদিকে এনবিআরের পাশাপাশি ক্রিসেন্ট লেদারের অর্থপাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। ভুয়া রপ্তানি বিলের মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের নগদ সহায়তা নেওয়া ৪০৮ কোটি ফিরিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জনতা ব্যাংকের হিসাব থেকে এসব অর্থ কেটে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার পাশাপাশি সম্প্রতি ব্যাংকটির ১০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে ক্রিসেন্ট লেদারের চেয়ারম্যান এম এ কাদেরের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে কোম্পানিটির ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক এবং এমডি (এম এ কাদেরের স্ত্রী) সুলতানা বেগম খোলা কাগজকে বলেন, আমরা কোনো অন্যায় করিনি। আমার দেশের চামড়া শিল্পের অন্যতম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। দেশের চামড়াশিল্প বিকাশে আমাদের অবদান আছে। ব্যবসার সঙ্গে ঋণ নিয়েছি। এখন সেই ঋণ নিয়ে কথা উঠেছে। ঠিক আছে তদন্ত হোক। আমার সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই।

 
Electronic Paper