ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সব সূচক শুধুই নিম্নমুখী

জাফর আহমদ
🕐 ১০:৫০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৫, ২০১৯

আমানতকারীদের অর্থ লুটপাট, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় বিপর্যস্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংককে ২০০৭ সালে অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর মালিকানা বদল হয়। কয়েকবার ব্যাংকের নামেও আসে পরিবর্তন। ওরিয়েন্টাল ব্যাংক হয় আইসিবি ইসলামী ব্যাংক।

এরপর এক দশকের বেশি সময় অতিবাহিত করলেও ব্যাংকটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বরং যত সময় যাচ্ছে ব্যাংকটি লোকসান, খেলাপি ঋণ আর দেনার দায়ে তলিয়ে যাচ্ছে। সবশেষ ব্যাংকটি দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার শিখরে ওঠা সদ্য সাবেক ফারমার্স ব্যাংককেও ছাড়িয়ে গেছে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকটির আর বিন্দু পরিমাণ আর্থিক সংগতি নেই। সর্বশেষ মূলধন ঘাটটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেতে পেতে নিয়মিত ঋণ নিঃশেষ হয়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির গ্রাহকের কাছে থাকা ঋণের পরিমাণ ৮৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৭০৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার ৮২ শতাংশ। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই মন্দ মানের ঋণ। খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দমানের ঋণের বেশি মানে টাকা ফেরত আসাটাও অনেকটা অনিশ্চিত। এ কারণে আমানতের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের দায়ও বেড়ে যায়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির প্রভিশন সংরক্ষণেও ব্যর্থ হয়।

ব্যাংকটির একটি সূত্র জানিয়েছে, বিতরণ করা ঋণ ফেরত না আসার কারণে খেলাপি বেড়েছে। আর এসব গ্রাহকের কাছে থেকে ঋণ ফেরাতে না পারার কারণে সব ঋণই মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। আর খেলাপি ঋণ মন্দ পর্যায় অতিক্রম করার কারণে এসব ঋণ ব্যাংককে অবলোপনে (রাইট-আপ) যেতে বাধ্য হয়।

সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংকটির অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ৮৫৮ কোটি টাকা। কোন ব্যাংকের ৮৫৬ কোটি টাকা আউটস্ট্যান্ডিং (গ্রাহকের কাছে থাকা ঋণ) ঋণের মধ্যে ৭০৭ কোটি টাকা বা ৮২ শতাংশ খেলাপি। আর ৫৮৫ কোটি টাকা অবলোপন হওয়া নজিরবিহীন।

ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তর হওয়ার সময় অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও গ্রাহকের আস্থাহীনতায় নিপতিত অবস্থা থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক দশকের বেশি সময়েও কোনো আশা জাগাতে পারেনি। ব্যাংকটির ৩৩টি শাখার মধ্যে ১৯টিই লোকসানি। দুই বছর আগেও লোকসানি শাখার সংখ্যা ছিল ১১টি।

ব্যাংকটির নিট মুনাফার ক্ষেত্রেও অবনতি হয়েছে। ২০১৬ সালে ব্যাংকটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ২৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। সর্বশেষ ব্যাংকটির মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের মাঝেও হতাশা বিরাজ করছে।

সম্পদের ক্ষেত্রেও অব্যাহতভাবে অধঃপতিত হয়েছে এই বাণিজ্যিক ব্যাংকটি। ২০১৬ সালে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল এক হাজার ২২৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ৩ বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে মোট সম্পদের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৮২ কোটি টাকা। এ সম্পদের মধ্যে ৯২১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ঝুঁকির মধ্যে। সূচকেই ব্যাংকটির অবস্থার ক্রমান্বয়ে অবনতি হয়েছে। একদিকে যেমন খেলাপি ঋণ বেড়েছে, প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে, অবলোপনকৃত ঋণ বেড়েছে, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে মুনাফার বদলে লোকসানের পাল্লাও ভারী হয়েছে ব্যাংকটির।

কয়েকটি শাখা ঘুরে দেখা গেছে, কর্মকর্তারা বসে থাকলেও গ্রাহকের দেখা নেই। ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াবে-এমন সম্ভাবনাও দেখছেন না ব্যাংকটির কোনো কর্মকর্তা।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষে জ্যেষ্ঠ জনসংযোগ কর্মকর্তা মীর মুর্তজা করিম খোলা কাগজকে বলেন, ‘একটি করাপটেড ওরিয়েন্টাল ব্যাংক থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের।

ব্যাংকটির গ্রাহকের দেনা এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা শোধ করেছি। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ শোধ না করে বিনিয়োগ করলে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক আর দশটি মুনাফা করা ব্যাংকের কাছাকাছি পৌঁছে যেত।’ তিনি বলেন, ‘আইসিবি ইসলামী ব্যাংক খেলাপি ঋণ, অবলোপনকৃত ঋণ বা সমন্বিত বকেয়া বেশি হলেও পরিচালকরা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন। পরিচালকরা ঋণ মওকুফ করে নেননি।’

ব্যাংকটির মালিকানা ও নাম বারবার পরিবর্তন হলেও পরিচালনার ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য, সততা ও দক্ষতার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। ব্যাংকের শাখাগুলো রাজধানীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে অবস্থিত হওয়ার পরও সুবিধা করতে পারেনি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ওরিয়েন্টাল ব্যাংক মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানির মালিকানায় যাওয়ার সময় মনে করা হয়েছিল ব্যাংকটিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু তা হয়নি। ব্যাংকটি মালয়েশিয়ার যে কোম্পানির মালিকানায় যায় তাদের আরও ব্যাংক আছে। প্রথম থেকেই তারা ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা দেখাতে পারেনি। এ ব্যাংককে টেনে তুলতে প্রথমত যারা মালিক তারা যদি বিনিয়োগ বাড়ান বা বড়সড়ো কোনো কোম্পানি এগিয়ে আসতে পারে। দ্বিতীয়ত, ব্যবস্থাপনাকে আরও একটিভ হতে হবে। ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। দক্ষ লোক নিয়োগ দিতে হবে। প্রয়োজনে পুরনো লোক যাচাই-বাচাই করতে হবে। আর এটা সম্ভব না হলে ব্যাংকটিকে অন্য একটি ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দিতে হবে।’

আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ২০০৭ সাল পর্যন্ত ওরিয়েন্টাল ব্যাংক হিসাবে পরিচিত ছিল। অর্থ লুটপাটের অভিযোগে ২০০৬ সালের ১৯ জুন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগ দেয়। জানা গেছে, ওরিয়ন গ্রুপের মালিক ওবায়দুল করিমসহ কয়েকজন শেয়ারহোল্ডার বিধি লঙ্ঘন করে বেনামে ১০ শতাংশের বেশি ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের শেয়ার ধারণ করছিলেন। সে সময় ৭০০ কোটি টাকা তছরুপেরও অভিযোগ ওঠে ওই শিল্প গ্রুপটির বিরুদ্ধে। নানা অনিয়ম প্রমাণিত হওয়া এবং ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৪(ক) ধারা লঙ্ঘন করায় শেয়ারধারীদের ৮৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ শেয়ার বাংলাদেশ ব্যাংক নিজের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে নেয়।

২০০৭ সালের ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্থগিত করে এবং পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয় স্কিম তৈরি করে। তখন মালয়েশিয়ার আইসিবি ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ ব্যাংকটির প্রায় ৫১ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় ৩৫১ কোটি টাকায়। আইসিবি গ্রুপ ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক নামকরণ করে।

ওরিয়েন্টাল ব্যাংক নামধারণ করার আগে ব্যাংকটির নাম ছিল আল-বারাকা ব্যাংক। জেদ্দাভিত্তিক শিল্পপতি আমানুল্লাহ মিয়া ও বাংলাদেশের শিল্পপতি আবুল খায়ের লিটুর মালিকানায় ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে আল-বারাকা ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করে। আমানুল্লাহ মিয়ার মৃত্যুর পর তার ছেলে শেয়ার বিক্রি করে দেয় হংকংভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। ২০০২ সালে তাদের পরামর্শে এর নামকরণ হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক।

২০০৪ সালে আবারও মালিকানা পরিবর্তিত হয়। সে বছরের নভেম্বরে ব্যাংকটির সিংহ ভাগ শেয়ার কিনে নেয় ওরিয়ন গ্রুপ। এর দুই বছরের মধ্যেই ব্যাংকটিতে দুর্নীতি শুরু হয়।

 
Electronic Paper