লাফিয়ে বাড়ছে স্বর্ণের দাম
কেউ জানেন না কত মজুদ
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৫৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৯, ২০১৯
লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে স্বর্ণের দাম। এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৭ দফা বেড়েছে দাম। গত একমাসের মধ্যেই দাম বেড়েছে তিনবার। জানুয়ারি মাসে স্বর্ণের দাম যেখানে ছিল ভরিপ্রতি ৪৮ হাজার ৯৮৮ টাকা সেখানে গতকাল থেকে ভরিপ্রতি স্বর্ণের দাম হয়েছে ৫৬ হাজার ৮৬২ টাকা। ঘন ঘন স্বর্ণের দাম বাড়ানোর পেছনে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি বা বাজুস-র যুক্তি হলো চীন-ভারত বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে স্বর্ণের। তবে স্বর্ণকাররা এ যুক্তি মানছেন না। এত ঘন ঘন স্বর্ণের দাম বাড়াতে তারা রীতিমতো অবাকই হচ্ছেন। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তাদের বাণিজ্যেও।
এদিকে বাংলাদেশে যে স্বর্ণনির্ভর ব্যবসা সেটার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশে কি পরিমাণ স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কারের মজুদ আছে তা কারও জানা নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বলা হচ্ছে, বছরে স্বর্ণের চাহিদা ৪৩ হাজার টনের মতো। স্বর্ণনির্ভর ব্যবসার বাজার প্রায় ১৮-২৫ হাজার কোটি টাকার মতো। চাহিদার সবটা স্বর্ণই আসে বাইরে থেকে। তবে সিংহ ভাগই অবৈধ পথে। টিআইবির এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে আসা স্বর্ণের শতকরা ৯০ ভাগই আসছে অবৈধ পথে। বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণকাণ্ডের পর আপন জুয়েলার্সে অভিযান চালায় শুল্ক গোয়েন্দারা। সে সময় আপন জুয়েলার্সের পাঁচটি শো-রুম থেকে সাড়ে ১৩ মন স্বর্ণ জব্দ করা হয়। যার আনুমানিক বাজার মূল্য আড়াইশ’ কোটি টাকা। বৈধ কোনো কাগজপত্র ছাড়াই এসব স্বর্ণ আমদানি করে আপন জুয়েলার্স। এ ঘটনার পর সরকার স্বর্ণ আমদানি নীতিমালা করার উদ্যোগ নেয়। গত বছর অক্টোবর মাসে মন্ত্রিসভা নীতিমালাটি অনুমোদন দেয়।
এ নীতিমালার আলোকে স্বর্ণ আমদানি যারা করতে চান তাদের লাইসেন্স করার জন্য অনলাইনে আবেদনপত্র দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এতে খুব কমই সাড়া মিলেছে।
বাংলাদেশে যে স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কার আসে এর সিংহ ভাগই আসে চোরাইপথে। বিশাল এ চোরাই ব্যবসা বছরের পর বছর চললেও সরকার এখান থেকে বড় অঙ্কের শুল্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে স্বর্ণ ব্যবসা পুরোপুরি আইনি কাঠামোতে আনা কঠিন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। কেননা স্বর্ণ অন্যতম আন্তর্জাতিক কারেন্সি। স্পর্শকাতর এ ধাতুটির মাধ্যমে অনেক লেনদেন হয়।
গতকাল থেকে ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ভরিতে ১ হাজার ১৬৬ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এর আগে, গত ৮ আগস্ট স্বর্ণের দাম প্রতি ভরিতে এক হাজার ১৬৬ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা এসেছিল। এর একদিন আগে ৬ আগস্ট সব ধরনের স্বর্ণের দর একই পরিমাণ বাড়ানো হয়েছিল। গত ২৪ জুলাই আরেক দফা বাড়ানো হয়েছিল স্বর্ণের দর। তখনো ভরিতে ১ হাজার ১৬৬ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। এর আগে বাজেট কার্যকর হওয়ার পর ৩ জুলাই একদফা ১ হাজার ১৬৬ টাকা দাম বাড়ানো হয়। তার আগে বছরের শুরুতেই জানুয়ারি মাসের ২ তারিখ ১ হাজার ৫১৬ টাকা ও ২৯ তারিখ ১ হাজার ১৬৬ টাকা বাড়ানো হয় স্বর্ণের দাম। তবে ১৭ জুন একদফায় ১ হাজার ১৬৬ টাকা কমানো হয় দাম। এ বছরের সাড়ে আটমাসে সাত দফায় ভরিপ্রতি স্বর্ণের দাম বেড়েছে প্রায় ৭ হাজার টাকা
এ বছরে স্বর্ণের বাজারের যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তাতে নাখোশ স্বর্ণকাররা। দামের এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ক্রেতাশূন্য করছে তাদের ব্যবসা। পুরান ঢাকার তাঁতী বাজারে ঢাকা স্বর্ণ শিল্পী শ্রমিক সংঘের কার্যকরী সদস্য বাবুল দাস জানান, গত এক মাসে তাদের কাছে কাজের অর্ডার একদম আসেনি বললেই চলে। তিনি বলেন, এত ঘন ঘন স্বর্ণের দাম বাড়ছে যে অনেকেই ভাবছে দাম একটু কমে আসুক দেখি। কমলে বানাবে। কিন্তু বরং দাম বেড়েই চলেছে।’ পাকা সোনার বদলে গিনি সোনার দাম বাড়ছে এ কারণে তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ঘিয়ের থেকে তেলের দাম বাড়ার মতো হলো বিষয়টা। পাকা সোনার চেয়ে খাদ দেওয়া স্বর্ণের দাম বাড়ছে। কিন্তু হওয়ার কথা উল্টোটা। গিনি সোনার দাম কম হওয়ার কথা।’
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ছে তাই আমাদের দাম বাড়াতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বছরের শুরু থেকে পর্যায়ক্রমে আউন্স প্রতি স্বর্ণের দাম বেড়েছে আড়াইশ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় আনুমানিক একুশ হাজার টাকা। ভরি প্রতি আট হাজার টাকা। কিন্তু আমরা একবারে না বাড়িয়ে পর্যায়ক্রমে বাড়াচ্ছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বর্ণ আমদানি শুরু না হলেও যারা লাগেজে করে স্বর্ণ আনেন, তারাও তো আন্তর্জাতিক বাজারের দরেই সেটি কিনে আনেন। যারা রিসাইকেল করা স্বর্ণ কিনছেন তারাও ওই আন্তর্জাতিক বাজারের দাম অনুসরণ করেন।
আগরওয়ালা দাবি করেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে তার প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক স্বর্ণের বাজারে। তার যুক্তি চীনের নানা ধরনের পণ্যের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেন, তখন চীন ডলার ছেড়ে দিয়ে স্বর্ণের রিজার্ভ বাড়িয়ে দিলেন। এতে ডলারের দরপতন হয়। যার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের ক্রাইসিস সৃষ্টি হয়ে দাম ঊর্ধ্বগতি হয়ে গেছে।’ তার আশঙ্কা স্বর্ণের দাম সামনে কমার কোনো লক্ষণ নেই। সামনে দাম আরও ঊর্ধ্বগতি হবে।
অর্থনীতিবিদরা এ যুক্তিকে মানতে নারাজ। তারা মনে করছেন, এতদিন ধরে বিশৃঙ্খলভাবে চলে আসা স্বর্ণ ব্যবসায়ে লাগাম টানার জন্য সরকার যে স্বর্ণ আমদানি নীতিমালা করেছে তাতে নিজেদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলেই ঘন ঘন স্বর্ণের দাম বাড়ানোর পথে এগুচ্ছে বাজুস। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা বলেন, স্বর্ণের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে তো আগেও বেড়েছে। কিন্তু এখন তারা দামের সামঞ্জস্য করতে হচ্ছে বলছে কেন? স্বর্ণ আমদানিতে সরকার এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার চেষ্টা করছে। এর সঙ্গে নিশ্চয়ই কিছু আর্থিক বিষয় জড়িত। অবৈধ পথে আসলে অনেক টাকা ফাঁকি দেওয়া যায়। এখন তারা সেই খরচ মিনিমাইজ করার চেষ্টা করছে বলে আমি মনে করি।’