ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বড় পরিবর্তন ছাড়াই বাজেট পাস

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
🕐 ১০:৪২ অপরাহ্ণ, জুন ৩০, ২০১৯

বড় কোনো পরিবর্তন ছাড়াই চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট পাস হলো। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছরের প্রথম বাজেট এটি। আর অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেট। গতকাল রোববার স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সকাল ১০টায় অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনে কণ্ঠভোটে বাজেট পাস হয়। নানা রেকর্ড ও ঘটনায় পূর্ণ এ বাজেট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যৌথভাবে উপস্থাপন করেন।

বাজেট উপস্থাপনের সময় ভ্যাট আইন-২০১২ কার্যকর, কর্মসংস্থান বাড়াতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা দূরীকরণে কথা বলা হয়েছিল। তবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপের উল্লেখ ছাড়াই পাস হলো বাজেট। ফলে বাজেট নিয়ে সরকারের বক্তব্যে যে আশার সঞ্চার হয়েছিল তা পূরণে ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে।

গত ১৩ জুন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল সংসদে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন শুরু করেন। বাজেটের অংশ বিশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পড়েন। রোববার প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় উপনেতা নেতা রওশন এরশাদের উপস্থিতিতে তা পাস হয়। প্রথমবারের মতো অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ব্যয়ের বিবরণ বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন, যা বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশের সমান।

বার সর্বোচ্চ সংখ্যক মন্ত্রী-এমপি বাজেট আলোচনায় অংশ নেন। ১৩ জুন বাজেট উপস্থাপন হওয়া পর মোট ১৫ কর্মদিবসে ২৭০ জন বক্তব্য দেন। সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, অর্থমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীসহ অন্যরা বাজেটের ওপর বক্তব্য দেন। বিরোধী দলের সদস্য বাজেটের নানা বিষয়ে অসংগতি তুলে ধরে আলোচনায় অংশ নিলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারি দলের সদস্যদের উপস্থিতিতে সুবিধা করতে পারেননি। তারা বেশ কিছু সংশোধনী প্রস্তাব আনলেও কণ্ঠভোটে তা বাতিল হয়ে যায়।

পাস হওয়া বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ২২ শতাংশ বেশি। এবার পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে ১৬ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে ৬০ হাজার ১০৯ কোটি টাকা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধেই যাবে, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের ১৯ শতাংশের বেশি। নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের ৭২ শতাংশ রাজস্ব খাত থেকে পাওয়ার আশা করছে সরকার। বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৯ শতাংশের বেশি।

এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে সরকারের তরফ থেকে আশা করা হচ্ছে। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। বিদায়ী বছরের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে। এ অংশ ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৭ দশমিক ২১ শতাংশের মতো।

বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। আয়কর ও মুনাফার ওপর কর থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিদায়ী সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ৯৫ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা।

নতুন অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আজ শুরু হচ্ছে। গতবছর প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা বেশি ভ্যাট আদায় করতে হবে। গতবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর নিয়ে ব্যবসায়ীদের মাঝে আতঙ্কও বিরাজ করছে। রাজস্ব বোর্ডের তরফ থেতে বলা হচ্ছে, ভ্যাট আইন কার্যকর হলে ভ্যাটের হার বাড়বে না। কিন্তু নতুন করে ১৯ হাজার কোটি টাকা বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করায় এনবিআরের আশ^াসে আশ^স্ত হতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে ভ্যাট নিয়ে আতঙ্ক নিয়েই শুরু হচ্ছে নতুন অর্থবছর।

এছাড়া নতুন বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ৩৬ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৪৮ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৫৪ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ২ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর বৈদেশিক অনুদান থেকে ৪ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা পাওয়া যাবে বলে বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছিলেন। বাজেটেও তা কার্যকর থাকছে। যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে তিনি এবার নতুন কোনো কর আরোপ করছেন না। করের আওতা বাড়িয়ে তিনি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চান।

সংসদে পাস হওয়া বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশের সমান। এই ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রীর সহায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ। তিনি আশা করছেন, বিদেশ থেকে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ করে ওই ঘাটতি মেটানো যাবে।

বাজেটে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা বলা হলেও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে সব উদ্যোগের কথা ছিল সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপের পথনকশা নেই। বিনিয়োগের পথে যে সব সমস্যা তা দূরীকরণে কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। নতুনদের কর্মসংস্থানের জন্য যে ১০০ কোটি টাকা রাখা হলেও তা ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। ব্যাংকিং খাত নিয়ে মানুষের যে হতাশা তৈরি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণে কোনো পদক্ষেপও নেই।

মঞ্জুরি দাবি ও ছাঁটাই প্রস্তাব
আগামী অর্থবছরের বাজেটের ওপর সংসদে উত্থাপিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ খাতের ৫৯টি মঞ্জুরি দাবির বিপরীতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, বিএনপির সদস্যরা ৪৮৪টি বিভিন্ন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব আনেন। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দাবি ও ছাঁটাই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়।

নির্দিষ্টকরণ বিল পাস
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ব্যয়ের বাইরে সরকারের বিভিন্ন ধরনের সংযুক্ত দায় মিলিয়ে মোট ৬ লাখ ৪২ হাজার ৭৮৩ কোটি ২৭ লাখ ২০ হাজার টাকার নির্দিষ্টকরণ বিল জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে পাস হয়েছে।

এর মধ্যে, সংসদ সদস্যদের ভোটে গৃহীত অর্থের পরিমাণ ৪ লাখ ৮০ হাজার ৫১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায় ৬ লাখ ৪২ হাজার ৪৭৮ কোটি ২৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। সংযুক্ত তহবিলের দায়ের মধ্যে ট্রেজারি বিলের দায় পরিশোধ, হাইকোর্টের বিচারপতি ও মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের বেতনও অন্তর্ভুক্ত।

 
Electronic Paper