সুইস ব্যাংকে বাড়ছে বাংলাদেশিদের টাকা
অর্থনীতির জন্য মন্দ না ভালো
শফিক হাসান
🕐 ১০:৩৯ অপরাহ্ণ, জুন ২৮, ২০১৯
সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে গত বছর বাংলাদেশিদের অর্থ বেড়েছে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা। পাচারকৃত এ টাকার বিষয়ে শুরু হয়েছে কড়া সমালোচনা। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এটাকে মন্দ বলছেন আবার ভালোও বলছেন কেউ কেউ। টাকা পাচারের পেছনে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন রয়েছে বলে মনে করছেন তারা। দেশে আনুষঙ্গিক সুবিধা ও নিরাপত্তার অভাববোধের কারণেই অনেকে বিদেশি ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছেন কেউ কেউ। অন্যদিকে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ পাচারকৃত অর্থে ইতিবাচক দিক খুঁজে পেয়েছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে শক্তিশালী হচ্ছে, টাকা জমছে উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের হাতে- সুইস ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ টাকা যাওয়া তারই সূচক। অধিকাংশ মানুষই পাচার হওয়া অর্থকে নেতিবাচকতার দৃষ্টান্ত হিসেবেই আখ্যায়িত করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ খোলা কাগজকে বলেন, সুইস ব্যাংকে এ টাকা পাচার দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ারই অংশ। আগেও পাচার হয়েছে। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে সরকারের জোরালো কোনো ভূমিকা আমরা দেখিনি। এমন নিষ্পৃহ ভাব বজায় থাকলে টাকা পাচারের হার আরও বাড়বে। এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেন খ্যাতনামা এ অর্থনীতিবিদ।
গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ বৃদ্ধি বিস্ময়কর। এক বছরের ব্যবধানে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৯ শতাংশ বা ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বেড়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০১৮’ বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বাংলাদেশিদের অর্থ জমার তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে এ প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী- ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৫ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে পরিমাণ ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৪ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশিদের অর্থ জমার পরিমাণ কম ছিল।
এসএনবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ বেড়েছিল। ২০১৩ সালে বিভিন্ন সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৭ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয় প্রায় ৫১ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা ৪ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ থেকে অর্থ জমার পরিমাণ বাড়লেও প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তানের নাগরিকের জমার পরিমাণ কমেছে অনেক। কমার কারণ হিসেবে জানা গেছে, ভারত সরকারের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের এ সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। যে কারণে ভারত সরকার সে দেশের অনেক অর্থ পাচারকারীর তথ্য সুইজারল্যান্ড থেকে সংগ্রহ করেছে। পরে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কোনো চুক্তি বা ব্যবস্থা না থাকায় টাকা পাচারের ঘটনা বাড়ছে।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) জানায়, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে অর্থ জমার তথ্য দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থও রয়েছে। তাই জমা হওয়া অর্থের পুরোটাই অবৈধ বা পাচারকৃত বলা যাবে না। দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে কারা অর্থ জমা করেছে, সেই তথ্য জানার চেষ্টা চলছে।
সারা দেশ যখন সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারের সমালোচনা মুখর, বিশেষজ্ঞদের একাংশ দাবি করছেন- বিভিন্ন কারণে সুইস ব্যাংকে আমানত বাড়ছে। সমৃদ্ধির বিষয়টিকে নেতিবাচক মনে করার কারণ নেই। এ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশিদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়ার বিষয় নির্দেশ করে। বেশ কয়েকটি কারণে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা বাড়ছে। দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকা; বিনিয়োগ বৈচিত্র্য আনতে অনেকেই বিদেশে টাকা নিয়ে যান। বাংলাদেশের বড় রকমের ধনীরা সেখানে টাকা জমা রাখতে পছন্দ করেন। পরে প্রয়োজন অনুযায়ী, সেখান থেকে টাকা তুলে বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করা হয়।
আরেকটি কারণ হচ্ছে- কালো টাকা। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভয়েও অনেকে বিদেশমুখী হচ্ছেন। কালো টাকার মালিকরা ঘোষণা দিয়ে বিনিয়োগ করতে চান না। এতে করে কালো টাকার মালিকের আশঙ্কা থাকে বিনিয়োগ করলে চিহ্নিত হয়ে যাবেন। সরকারিভাবে হয়রানির শিকার হতে পারেন। সরকার পরিবর্তন হলেও হয়রানির আশঙ্কা থেকে যায়।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বৈধ পথে আয় করা টাকাও অনেকে রাখছেন সুইস ব্যাংকে। ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন দেশে পড়ালেখা করানোর জন্যই টাকা রাখছেন সুইস ব্যাংকে। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠানোর ঝামেলায় যেতে চান বলেই বেছে নেন সুইস ব্যাংককে।
প্রসঙ্গত, সুইজ্যারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো সাধারণত গ্রাহকদের তথ্য গোপন রাখে। দেশটির ব্যাংকের সংখ্যা ২৪৮। সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষণা মতে- নাগরিকত্ব গোপন রেখেছে এমন বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থ হিসাবে রাখা হয় না। গচ্ছিত সোনা কিংবা মূল্যবান সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমানও হিসাবে ধরা হয়নি। অত্যন্ত গোপনে টাকা রাখা হয়। কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা ইচ্ছা করলেও অ্যাকাউন্টধারীর পূর্ণাঙ্গ পরিচয় জানতে পারেন না। সব তথ্য থাকে অল্প ক’জন কর্মকর্তার হাতে। ফলে ওইসব কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কেউ গ্রাহকদের পরিচয় জানেন না। শুধু একটি কোড নাম্বার ও পাসওয়ার্ডের ভিত্তিতে চলে লেনদেন। জরুরি প্রয়োজনে গ্রাহকদের সন্ধান করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
বিভিন্ন দেশের কর ফাঁকি দেওয়া বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা পাচার করে সুইস ব্যাংকগুলোতে রাখা হতো। এ ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনার মুখে সুইস সরকার ব্যাংকিং আইনের সংশোধনী আনছে। একই সঙ্গে বিধিবিধানেও পরিবর্তন এনেছে। নতুন আইনে শুধু নাম-ঠিকানা হলেই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে না। গ্রাহকের টাকার উৎস জানাতে হবে। বছরে কত লেনদেন হবে তার সীমাও ব্যাংককে জানাতে হবে। কোনো কারণে সীমার বেশি লেনদেন হলে সেই বিষয়ে ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা দিতে হবে। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো সব অনলাইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ফলে যে কোনো দেশ থেকে লেনদেন করা সহজ। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের চাপের মুখে বিগত কয়েক বছর যাবৎ সুইস ব্যাংক পৃথিবীর কোন দেশ থেকে কত টাকা জমা হয়েছে এ তথ্য জানাতে বাধ্য হচ্ছে।