বেসরকারি ব্যাংক ঋণস্থিতির চালক
জাফর আহমদ
🕐 ১১:০৫ অপরাহ্ণ, জুন ১৯, ২০১৯
ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭০২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৯১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। আর বাকি ৭ লাখ ৪১ হাজার ৮২২ কোটি ৭ লাখ টাকা বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। যা মোট ঋণস্থিতির প্রায় ৭৯ ভাগ।
কয়েক বছর আগের অর্থনীতিতে চালকের আসনে ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বেসরকারি খাতের প্রসার, বিভিন্ন সরকারের সময়ে ব্যক্তি খাতের ব্যাংকের অনুমোদন, আমানত সংগ্রহে এসব ব্যাংকের প্রতিযোগিতা ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকিং খাতের চিত্র বদলে যায়। ব্যাংক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উদ্যোক্তার অর্থ যোগ হয় ব্যাংকের মূলধন হিসাবে। সেই সঙ্গে যোগ হয় আমানত। ফলে ব্যাংকিং খাতের ঋণস্থিতির ৮০ ভাগই চলে যায় দেশি-বিদেশি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি ২০১৯ সালের মার্চ প্রান্তিকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণস্থিতি ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭০২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৬ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণস্থিতির পরিমাণ ১ লাখ ৯১ হাজার ৯০৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। অন্যদিকে দেশি-বিদেশি ৪৯ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণস্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৪১ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের মাত্র ২১ ভাগ।
খেলাপি ঋণ বিবেচনায়, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৬ ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। খেলাপি ঋণের হার বিবেচনায় ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকের বেশি এসব রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের। টাকার অঙ্কে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫৮ হাজার ৬৬৭ কোটি ৯ লাখ টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৫২ দশমিক ৯১ ভাগ। আর বেসরকারি ৪৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৪৭ দশমিক ০৮ ভাগ বা ৫২ হাজার ২০৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অবদান বেড়েছে।
গত ১০ বছরের ব্যবধানে ঋণস্থিতির চিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু খেলাপি ঋণের চিত্র উল্টো। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অর্থনীতিতে অবদান কমে গেলেও খেলাপি ঋণের বোঝা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত এসব খেলাপি ঋণের হার ৩২ দশমিক ৩০ শতাংশ।
এর মধ্যে সর্বাধিক খেলাপি বিডিবিএল, বেসিক ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের। ব্যাংক তিনটির খেলাপি ঋণের হার যথাক্রমে ৫৬ দশমিক ২৭ শতাংশ, ৫৮ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং ৪৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত একেকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের সমান বেসরকারি ৪ থেকে ১০ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের সমান।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. সামস উল ইসলামের বক্তব্য ভিন্ন। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনীতিতে সেবা দিয়ে আসছে। সেই হিসাবে ব্যাংকগুলোর বয়স আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের সময়কালের সমান। অন্যদিকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বয়স ২ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত। এসব ব্যাংকের সেবার পরিধিও কম। সে কারণে সেবার বিস্তৃত এলাকার সঙ্গে টাকার অঙ্কও বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি বেশি। আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি যাতে খেলাপি ঋণ কমে আসে।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ছোট্ট হওয়ার পাশাপাশি খেলাপি ঋণের হারও সর্বনিম্ন। ৪৯টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণস্থিতি ৭৯ শতাংশ বা ৭ লাখ ৪১ হাজার ৮২২ কোটি ৭ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের গড় হার ৪৭ দশমিক ০৮ শতাংশ। তবে একক ব্যাংক হিসাবে এমন ব্যাংকও আছে যাদের খেলাপি ঋণের হার ৫০-এর উপরে। এর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৩২ শতাংশ, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৮২ শতাংশ এবং ফারমার্স ব্যাংকের ৫৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
এ ছাড়া বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের খেলাপি ঋণের হার ৯৬ শতাংশ। এসব ব্যাংক পরিচালনা অনিয়মের কারণে খেলাপি ঋণের সর্বোচ্চ হার ধারণ করেছে। তবে বেসরকারি এসব ব্যাংকের গড় খেলাপি ঋণের হার ৫ দশমিক ৭ শতাংশ।
এ বিষয়ে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী মনে করেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জবাবদিহি বাড়ার কারণে খেলাপি ঋণ কম। এ কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণের সময় খুব সাবধানতা অবলম্বন করে। খোলা কাগজকে তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের অনিয়মের খবরগুলো বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সতর্ক হতে সহায়তা করছে। শতভাগ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে জনগণের টাকার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং ব্যাংকের সুনাম ধরে রাখতে চায়। সব বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যেই এমন দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে।