তবু আশাবাদী ব্যবসায়ীরা
জাফর আহমদ
🕐 ১০:৫২ অপরাহ্ণ, জুন ১৫, ২০১৯
প্রস্তাবিত বাজেটে আর্থিক খাতের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। তাদের মতে, বাজেটের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী ব্যাংকিং খাতের অব্যবস্থাপনা দূর করতে যে উদ্যোগের কথা বলেছেন এটা ভালো। তবে তা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর। অতীতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা বেশি দূর এগুতে পারেনি। এ জন্য কিছুটা সংশয় রয়েছে তবে প্রস্তাবনার কঠোর প্রয়োগ হলে আশাবাদী হওয়ার মতো বাজেট এসেছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যাংকিং খাতের সর্বশেষ খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। যা মোট ঋণের প্রায় ১১ শতাংশের ওপরে। এর বাইরের বিপুল পরিমাণ ঋণ আছে অবলোপনকৃত। সবমিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের চেয়ে খারাপ খবর হচ্ছে, প্রথমত, দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের বাইরে যেসব ঋণ নিয়মিত আছে তার বড় অংশের অবস্থা খারাপ; নিয়মিত আছে শুধু খাতা-কলেম। দ্বিতীয়ত, যে হারে ঋণ বিতরণ হচ্ছে সে হারে ব্যাংকে ফেরত আসছে না। তৃতীয়ত, আমানতকারীরা আমানত রাখার ক্ষেত্রে ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্রমুখী হচ্ছে। এ অবস্থায় আর্থিক খাত তারল্য সংকটে পড়ছে। এতে বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ধারা সূচিত হয়েছে ব্যাংকি খাতের অব্যবস্থাপনা সব ম্লান করে দিচ্ছে।
এসব সমস্যা সমাধানে ব্যাংকিং খাতে কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ব্যবসায়ী এ উদ্যোগের বাস্তবায়ন দেখতে চায়। এ বিষয়ে দেশের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব চেম্বার অ্যান্ড কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) সহ-সভাপতি ও বিজিএমইএর সদ্য সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে যেসব কথা বলা হয়েছে ও খেলাপি গ্রাহকদের ব্যাপারে কঠোর হতে যেসব কথা বলা হয়েছে তা আশা জাগিয়েছে। ভালো ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত হয়েছেন। তবে এ জন্য বাস্তবায়ন চাই। ব্যাংকিং খাত যে পর্যায়ে পৌঁছেছে এ বক্তব্যের কঠোর বাস্তবায়ন চাই।
ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা কঠিন হয়ে গেছে। বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না। ব্যাংকের তারল্য না থাকার কারণে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ফিরে আসছেন। এতে সুদহার বেড়ে যাচ্ছে। এ দুরবস্থা বেসরকারি ব্যাংকে আরও বেশি প্রকট। এত দিন সরকারি আমানতের ৭৫ ভাগ থাকত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে রাখত। বেসরকারি ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ার কারণে তাদের ৫০ শতাংশ করে ভাগ করে দেওয়া হয়। বিধিবদ্ধ জমা হিসাবে ব্যাংকগুলো আমানতের যে হারে টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখত সে হারও সরকার কমিয়ে দিয়েছে। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে শর্ত দেওয়া হয় সুদহার কমিয়ে আনতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নীতি সহায়তার ফলে ব্যাংকিং খাতে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যায়। এতে সাময়িক অর্থের সরবরাহ বাড়ে। কিন্তু ঋণের সুদহার অপরিবর্তিত থাকার পাশাপাশি তারল্য সংকটও থেকে যায়। এর ফলে নগদ টাকার জন্য ব্যাংকিং খাতের যে হাহাকার ছিল তা থেকেই যায়।
এ বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন খোলা কাগজকে বলেন, ব্যাংকিং খাত নিয়ে বাজেট প্রস্তাবনায় আমরা আশাবাদী। সরকারও ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক। এ জন্য অংশীজনদের আন্তরিক হতে হবে। তা না হলে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। সুদহার কমাতে ২০১৮ সালে উদ্যোগ নেয় সরকার। তখন রাষ্ট্রায়ত্তগুলো সুদহার কমালেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো কমায়নি। যেসব ভালো ব্যবসায়ী খেলাপি হয়েছে তাদের সহযোগিতার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলেও উচ্চ আদালতে আটকে যায়। ফলে বাজেট প্রস্তাবনায় আমরা খুবই আশাবাদী যদি তা বাস্তবায়ন হয়।
ব্যাংক নিয়ে উদ্যোগের প্রস্তাবনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বাড়ানোর জন্য সরকার ব্যাংক কমিশন করবে বলে জানিয়েছে। আমি মনে করি, ব্যাংক কমিশন চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর আস্থা রাখতে পারলে তা বড় উপায় হতে পারে, কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক জানে সমস্যাটা কোথায়। তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে বা ক্ষমতা দিলে তারা সমস্যার সমাধান করতে পারবে। বাজেটে বলা উচিত ছিল, আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আইন মতে, সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে।
ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো ভেতর থেকে। যারা ব্যাংক মালিক তারাই উদ্যোক্তা। ফলে ব্যাংকের ভেতরেও সুশাসনের প্রয়োজন। বিশেষ করে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এ সমস্যা প্রকট। দিন দিন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অবদান বৃদ্ধির পাশাপাশি এ সংকটও প্রকট হচ্ছে।
এ বিষয়ে আতিউর রহমান বলেন, ঋণখেলাপি যারা তাদের বড় অংশই ব্যাংগুলোর মালিক। এরা এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকে নগদ টাকা ঢুকছে না। এরই ফলে ব্যাংক খাতে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। বাজেট অনুমোদেন ক্ষেত্রে এই জায়গাতেও নজর দেওয়া উচিত ছিল। ব্যবসায়ীরা মনে করছে, সমস্যা সমাধানে সরকার কতদূর এগুতে পারবে তার ওপর নির্ভর করছে বাজেটের সফলতা।