ব্যাংকিং খাতে স্প্রেড হ-য-ব-র-ল
জাফর আহমদ
🕐 ১১:২৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৩, ২০১৯
সুদ নির্ধারণে ব্যাংকিং খাতে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে স্প্রেড হার (আমানত সংগ্রহ ও বিতরণের মধ্যে পার্থক্য) কমানোর কত কথা বলা হলেও অনেক ব্যাংক এ নির্দেশনা মানছে না। নির্দেশনার দ্বিগুণও সুদ নিচ্ছে একাধিক ব্যাংক। আবার ঋণের আমানত সংগ্রহের চেয়ে কম সুদেও বিতরণ করছে কয়েকটি ব্যাংক। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটেই বিদ্যমান অব্যবস্থা দেখানো হচ্ছে।
এ অবস্থা ব্যাংকিং খাতে ‘আনহেলদি’ ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা এবি আজিজুল ইসলাম। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, সুদ নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংককে নির্দেশ দিতে পারে না, নৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক তা করছে। তারপরও ব্যাংকিং খাতের অতি খেলাপি ঋণ, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক ব্যাংক কিন্তু এক একটি ব্যাংকের কম সামর্থ্য এবং ব্যাংক মালিকদের অতি মুনাফার মানসিকতা ব্যাংকিং খাতের স্প্রেড হার অত্যাধিক।
২০০৭ সাল নাগাদ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতি নির্দেশনা ছিল স্প্রেড হার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে। এরপর নির্দেশনা আসে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে। একই সময়ে আমানত সংগ্রহে ৬ শতাংশ, আর ঋণ বিতরণে ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার ব্যাপারে পরামর্শ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময়ে এ নির্দেশনা মানতে সম্মতি দেয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মালিকরা। যদিও এ নির্দেশনা কার্যকর হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, ১১টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্প্রেড হার ৫ শতাংশের ওপরে। এর মধ্যে ৪ দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্প্রেড হার ৮ শতাংশের কাছাকাছি। ৫ শতাংশের কাছাকাছি স্প্রেড হার ১৩ বাণিজ্যিক ব্যাংকের। আর আমানতের চেয়ে কম সুদে অর্থাৎ ঋণাত্মক স্প্রেডে ঋণ বিতরণ করছে রাষ্ট্রমালিকাধীন দুই বাণিজ্যিক ব্যাংকের। ঋণ বিতরণে এ অবস্থা এক ধরনের খারাপ প্রবণতা তৈরি করছে। যা ব্যাংকিং খাতের সক্ষমতার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত দুই ব্যাংক আমানত সংগ্রহের চেয়ে কম সুদে বিতরণ করছে, এ অবস্থাও সুস্থ ব্যাংকিংয়ের জন্য কাম্য নয়।
দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ স্প্রেড হার স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড চার্টার্ড, ডাচ্-বাংলা, ব্র্যাক ব্যাংক ও সিডি ব্যাংক এনএর। ঋণাত্মক স্প্রেড হার বেসিক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের। বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড চার্টার্ড ব্যাংক ১ দশমিক ৭৮ সুদ হারে সংগ্রহ করে বিতরণ করছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ সুদে; সিটি ব্যাংক এনএ দশমিক ২৮ শতাংশ (আটাশ পয়সা) হারে আমানত সংগ্রহ করে বিতরণ করছে ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ হারে। হংকং সাংহাই ব্যাংকের ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ; ব্যাংক আল-ফালাহর ৫ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ এবং বিদেশি স্টেট ব্যাংক ইন্ডিয়ার স্প্রেড ৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। এসব বিদেশি ব্যাংকগুলোর গড় স্প্রেড হার ৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সিটি ব্যাংকের স্প্রেড হার ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ; সীমান্ত ব্যাংকের স্প্রেড হার ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ; ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের স্প্রেড হার ৮ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ; ব্র্যাক ব্যাংকের স্প্রেড হার ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ; প্রিমিয়ার ব্যাংকের স্প্রেড হার ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ; এনআরবি কর্মাশিয়াল ব্যাংকের ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং মধুমতি ব্যাংকের স্প্রেড হার ৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এ ছাড়া আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ; এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ; এনআরবির ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ; মেঘনা ব্যাংকের ৪ দশমিক ৭২ শতাংশ; শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ; ট্রাস্ট ব্যাংকের ৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ; ব্যাংক এশিয়ার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ ঢাকা ব্যাংকের ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ; প্রাইমের ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ; ইস্টার্ন ব্যাংকের ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং উত্তরা ব্যাংকের স্প্রেড হার ৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অন্যদিকে বেসিক ব্যাংকের মাইনাস দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মাইনাস দশমিক ৫৬ শতাংশ।
খেলাপি ঋণের অত্যাধিক হার ব্যাংকিং খাতে অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনা তৈরি করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ঋণ বিতরণ করলেই খেলাপি হয়। এ কারণে বেশি করে সুদ নেন। যদিও এ ব্যবস্থায় ভালো গ্রাহকদের প্রতি অবিচার করা হয়। পাশাপাশি আগে থেকেই বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে ব্যাংকিং খাতে। ভালো গ্রাহক এবং চলমান ঋণের ওপর বেশি হারে সুদ বসিয়ে এ টাকা তুলে নেয় ব্যাংকগুলো। ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। আর মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৯ লাখ ১১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। খেলাপি বা নন- পারফমিং ঋণের হার ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। এই খেলাপি ঋণের বোঝা সামলাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তুলনামূলক কম সুদে আমানত সংগ্রহ করে বেশি সুদে বিতরণ করছে। এর ফলে একদিকে আমানতকারীরা বঞ্চিত হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের বোঝা বাড়ছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটছে।