ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

খেলাপি ও প্রভিশন ঘাটতি ক্ষত

বিপর্যস্ত ব্যাংকিং খাত

জাফর আহমদ
🕐 ৯:৪২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৮

খেলাপি ঋণের ক্ষতের সঙ্গে বড় হচ্ছে প্রভিশন ঘাটতির গহবর। ফলে একদিকে ব্যাংকের টাকা অসৎ মানুষের পকেটে চলে যাচ্ছে, ফিরে আসছে না। অন্যদিকে প্রভিশন (খেলাপি ঋণের বিপরীতে গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার ফলে আমানতকারীর দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ (সেপ্টেম্বর, ২০১৮) তথ্যানুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি ৯২ লাখ টাকা। একই সময়ে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ১০ হাজার ৮৩৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৯ হাজার ৬৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা।


২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। আর এক বছরের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৩ হাজার ৭৩৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৯৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫২ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ২০ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে সে টাকা ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃতি ব্যাংকিং খাতকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বড় ধরনের উন্নতি হলেও এ উন্নতি ম্লান করে দিচ্ছে খেলাপি ঋণ।

বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে অসম সাহস দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বিভিন্ন প্রকার উদ্যোগ ও তা বাস্তবায়ন শুরু হওয়া অর্থনীতিকে বড় ধরনের উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। মানবসম্পদের উন্নয়ন প্রতিবেশী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাত হতাশ করেছে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খোলা কাগজকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতটি একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত ছিল। ’৯০-এর দশকে প্রাইভেট ব্যাংক এলো, ব্যাংকের নতুন সেবা এলো, ব্যাংকিং খাতে বিদেশি বিনিয়োগ এলো, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা কমলো, গ্রামগঞ্জে ঋণ দেওয়া শুরু হলো, মাইক্রোক্রেডিট এলো। ইদানীং মোবাইল ফিন্যান্সিং ও এজেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিছু উদ্ভাবনী মডেল এলো, বহির্বিশ্ব আমাদের ফলো করা শুরু করলো। কিন্তু সম্প্রতি ব্যাংকিং খাত আমাদের হতাশ করেছে। এর জন্য দায়ীর কথা চিন্তা করলে, সরকার তো অত সহজ ব্যাপার না। আমি একটু সুনির্দিষ্ট করে বলতে চাই, ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত সরকারের লোকজন সার্বিক ভাবমূর্তির চেয়ে নিজের স্বার্থের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সম্পদ, ব্যবসা এসবই প্রাধান্য পাচ্ছে। এটা ব্যাংকের জন্য সুখকর নয়।

খেলাপি ঋণের পাশাপাশি প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকিং খাতে ক্ষতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রভিশন ঘাটতির অর্থ হলো সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো মুনাফা করতে পারছে না। ব্যাংকগুলোর ঋণের ঝুঁকি বিবেচনা করে তার বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণও বাড়ে। আর প্রভিশন ঘাটতি রেখে কোনো ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। এক সময় কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি থাকলে শুধু সতর্ক ও ঘাটতি মেটাতে দিকনির্দেশনা দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো ব্যাংকে টানা দুই বছর ঘাটতি থাকলে তার বড় অঙ্কের জরিমানাসহ লাইসেন্স বাতিলের কথা বলা হয়েছে। এসব কারণে নানা উপায়ে প্রভিশন ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করে ব্যাংকগুলো। কিন্তু এত কিছুর পরও কিছু ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতি রক্ষা করতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৩টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮৩৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ব্যাংকগুলো হলো, রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে এবি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এর মধ্যে এক বছরের অধিক সময় ধরে প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।

ব্যাংকিং খাতের সব ব্যাংকেই কম-বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে। তবে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি রয়েছে মোট ঋণের ১৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ বা ৫ হাজার ৯৬২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা; বিডিবিএল-এর ৫৫ দশমিক ১০ শতাংশ বা ৮৪৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা; বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬১ দশমিক ৭২ শতাংশ বা ৯ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা; জনতা ব্যাংকের ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ বা ১৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা; রূপালী ব্যাংকের ২২ দশমিক ২৪ শতাংশ বা ৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সবচেয়ে বড় সোনালী ব্যাংকের খেলাপি মোট ঋণের ৩৪ শতাংশ বা ১২ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মোট ঋণের ২০ দশমিক ৭৩ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মোট ঋণের ২৫ দশমিক ১৪ শতাংশ বা ১ হাজার ৩০৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ। রাষ্ট্রায়ত্ত এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মোট ৫৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।

 
Electronic Paper