ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রমজানে বাজার যেন আরও অস্থির না হয়

অনলাইন ডেস্ক
🕐 ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৩

রমজানে বাজার যেন আরও অস্থির না হয়

সারা বিশ্বের মুসলমানের কাছেই রমজান একটি অত্যন্ত পবিত্র মাস। বাংলাদেশও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং এখানেও রমজানে বিশেষ উৎসাহ-উদ্দীপনা আসে মানুষের জীবনে। এ সময়েই আমরা আবার লক্ষ করি, বাজারে বেশকিছু নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। প্রতিবারই এটি ঘটতে দেখা যায় এবং মনে হয়, এর কোনো প্রতিকার নেই। অথচ বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশে রমজানে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম কমানোর ব্যবস্থা করেন।

 

আমাদের দেশে যদি দামটা আগের পর্যায়ে রাখারও ব্যবস্থা হতো, তাহলেও রোজাদাররা খুশি হয়ে যেতেন। তারা মনে করতে পারতেন, ব্যবসায়ীরা একটি বড় সদাচরণ করেছেন। শুধু রোজাদার তো নয়, যারা রোজা রাখতে অসমর্থ বা সাধারণত রোজা রাখেন না, এমনকি যারা ভিন্নধর্মাবলম্বী নাগরিক, তারাও রমজান উপলক্ষ্যে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংকটে পড়েন।

এ অবস্থায় এবার একটি ভিন্ন কণ্ঠস্বর শোনা গেল ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতির। রমজানে বাজার স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে মতবিনিময়ের জন্য আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সম্প্রতি তিনি বলেছেন, আসুন আমরা এ রমজানে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে একটি নতুন অভ্যাস চর্চা শুরু করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদও কম দেখা গেল না।

মিলাররা দায়ী করেছেন পাইকারি ব্যবসায়ীদের। পাইকাররা মিলারদের। খুচরা ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা লাভের চেষ্টাকে তো সমসময়ই দায়ী করা হয়। অভিযোগ উঠেছে ‘পাকা রসিদ’ না দিয়ে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করার।

সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি হয় না বলে যে অভিযোগ আছে, সেটা স্বীকার করেই বলা হয়েছে-ওই দামে তারা কিনতেও পারেন না, বেচবেন কিভাবে? এফবিসিসিআই আয়োজিত বৈঠকে চিনির দাম নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা হয়েছে।

সেটা স্বাভাবিক, কারণ প্রতি রমজানেই দেখা যায় চিনির চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে নেই। এবার চিনি আমদানিও কম হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য রমজান আসতে এখনো দেরি আছে।

আমদানির জোর উদ্যোগ থাকলে এরই মধ্যে চিনি এনে ঘাটতি পূরণ করা যাবে। কোনো কোনো পণ্যের আমদানি আবার ভালো, যেমন ভোজ্যতেল। বাজারে এর দাম অনেক বেড়েছে আগেই এবং দাম কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। বাজারে ভোজ্যতেলের সংকটও নেই।

সেদিন একটি সংবাদপত্রে একজন অর্থনীতিবিদ লিখেছেন, পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও দাম বাড়তে পারে। কারণ সেটার উৎপাদন ব্যয় হয়তো বেশি। ভোজ্যতেল আমরা সিংহভাগই আমদানি করে থাকি।

চিনিও আমরা বেশিরভাগ আমদানি করি। আমদানির পর এ দুটি পণ্য দেশে কেবল পরিশোধন করা হয়। এসব আমদানিতে পরিবহণ খরচ অনেক বেড়েছে বলে খবরে প্রকাশ। এর কারণ জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়া।

তেলের দাম বাড়ার কারণ আবার ইউক্রেন যুদ্ধ। অনেকেই ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব আড়াল করে নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হওয়া নিয়ে আলোচনা করতে চান। তাদের কেউ কেউ হয়তো না বুঝে এটা করেন। তবে আরেক শ্রেণির লোক উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ আলোচনার অবতারণা করেন। তারা পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ খুঁজে দেখতে চান না এবং এ জন্য শুধু সরকারকে দায়ী করেন।

এটাও বলতে হবে, ডলারের দাম অনেক বেড়ে গেছে এবং বাজারে এর সংকট আছে। জরুরি পণ্যসামগ্রীর এলসি খুলতেও অনেক ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়ছে ব্যাংকগুলো। আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু পণ্যের দামও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এর মধ্যে।

এসব কারণে আগের চেয়ে বেশি দামে এগুলো আমদানি করতে হচ্ছে। বেশকিছু পণ্য আগের মতো সহজে আনা যাচ্ছে না। এসব খবর মিডিয়ায় আসছে; ব্যবসায়ীরাও বলছেন। আমরা এ বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারি না। আর এ পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশে নয়, অনেক উন্নত দেশেও সৃষ্টি হয়েছে।

খাদ্য পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পেলে, বিশেষ করে একযোগে বৃদ্ধি পেলে সেটাকে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে সারা পৃথিবীতেই দেখা দিয়েছে এ সমস্যা এবং সব দেশের সরকারই এ নিয়ে কমবেশি হিমশিম খাচ্ছে। আমাদেরও এ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। অনেক বছর ধরে আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে পথ চলছি, একথা অস্বীকার করা যাবে না।

এখন সরকারের পক্ষে সবকিছুর দাম বেঁধে দেওয়া সম্ভব নয়। তারপরও কিছু জরুরি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে সরকার। আবার দেখা যায়, বাজারে সেটা কার্যকর হচ্ছে না। এফবিসিসিআই’র বৈঠকে যে দিকটি উঠে এসেছে, এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখতে হবে।

এফবিসিসিআই যেহেতু ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এবং তারা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখার পাশাপাশি নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্যও কাজ করেন, সেজন্য তাদের উচিত হবে সরকারকে এতে সহায়তা করা।

এফবিসিসিআই সভাপতি রমজানে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রেখে নতুন অভ্যাস চর্চার যে আহ্বান জানিয়েছেন, সেটা এবার সব ক্ষেত্রে সম্ভব না হলেও দু-একটি জরুরি পণ্যের ক্ষেত্রে অন্তত এ চেষ্টা করা যেতে পারে।

রমজানে সব জিনিসের চাহিদা বেড়ে যায়, এটা কিন্তু ঠিক নয়। নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের চাহিদা অনেক বাড়তে দেখা যায়। সেসব পণ্যেরই দাম বৃদ্ধি পায় বেশি। এজন্য ভোক্তাদেরও অনেক ক্ষেত্রে দায়ী করা হয়।

বাজারে পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও অনেক ভোক্তাকে দেখা যায় রমজান শুরুর আগেই অহেতুক পণ্যসামগ্রী কিনে ঘরে এনে জমা করতে। এতে বাজারে এক ধরনের সংকট সৃষ্টি হয় এবং এর সুযোগে কিছু ব্যবসায়ী ওইসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন।

ভোক্তারা বুঝতে পারেন না, তাদের এমন আচরণের কারণে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে এবং এতে সাধারণ মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এজন্য আগে থেকে প্রচারণা চালাতে হবে। ব্যবসায়ী নেতারা, সেই সঙ্গে মিডিয়া এ বিষয়ে জনমত গড়ে তুলতে পারে।

রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি হারে বেড়ে যায়, সেগুলোর আমদানি যেন কোনোভাবে ব্যাহত না হয়। অন্যান্য পণ্যের আমদানি কমিয়ে দিয়ে হলেও এ সময়ে বাজার শান্ত রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

ঠিকমতো আমদানি হওয়ার পরও সরবরাহ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়ে থাকে। সে কারণেও সংকট দেখা দেয় এবং অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। ভুল রিপোর্টিংয়ের কারণেও পণ্যসামগ্রীর বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে থাকে।

এদিকে মিডিয়া পরিচালনাকারীদের সুদৃষ্টি রাখতে হবে। সরকার টিসিবির মাধ্যমে কিছু জরুরি পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করে কম দামে। এ সময়ে এই কার্যক্রম বাড়াতে হবে। তালিকায় নতুন পণ্যসামগ্রী যোগ করতে হবে রমজানে। টিসিবির কার্যক্রম নির্দিষ্ট কিছু শহর এলাকায় সীমাবদ্ধ বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগ অন্তত রমজানে যাতে না ওঠে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

আমরা একটি দীর্ঘ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছি এবং তারপর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক মানুষ এর মধ্যে কাজ হারিয়েছে, অনেকের আয় কমে গেছে এবং এর পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে। রমজানের আগেই বাজার যেহেতু চড়া, সেজন্য এ মাসে নতুন করে জিনিসপত্রের দাম যাতে না বাড়ে, সে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

এমন পূর্বাভাসের খবর রয়েছে যে, রমজানে বেশকিছু পণ্যের দাম আরও ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বাড়তে পারে। এ ধরনের পূর্বাভাসও বাজারে প্রভাব সৃষ্টি করে এবং এতেও দাম বেড়ে যায়। পূর্বাভাস যারা দেওয়ার, তারা সেটা দেবেন। সরকারকেও এসব বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার মাঝে একযোগে কয়েকটি জ্বালানি পণ্যের দাম অনেক বাড়িয়েছিল।

তখন এর প্রভাব পড়ে বাজারে এবং জিনিসপত্রের দাম দ্রুত বেড়ে যায়। তখন বলা হচ্ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমে এলে সরকার যেন দেশে এর দাম কমায় এবং বাজারে এর প্রভাব যাতে পড়ে, সেই ব্যবস্থা করে। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমতে শুরু করে। কিছু নিত্যপণ্যের দামও সেই বাজারে কমে আসার প্রবণতা দেখা গেছে। এর সুযোগ নিতে হবে। রমজান শুরুর আগেই জ্বালানির দাম কিছুটা কমানো যায় কিনা, সে চিন্তা করা প্রয়োজন।

সরকার গ্যাস, বিদ্যুতের দামও বাড়িয়েছে এবং ধাপে ধাপে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় আছে। এমন পদক্ষেপের প্রভাব শিল্প, কৃষি ও ব্যবসার ওপর পড়ে এবং ফলে ওইসব ক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ অবস্থায় রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা ভালো না থাকলে, উপরন্তু বেশকিছু লোক বেকার হয়ে পড়লে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, সেটা সহজেই বোধগম্য।

শুধু খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে চলেছে, তা তো নয়। মানুষের যাতায়াত খরচ বেড়েছে। তাদের ছেলেমেয়ের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার খরচ বেড়ে গেছে। সম্প্রতি এমন একটি খবর সংবাদপত্রে দেখেছি যে, মানুষ অর্থসংকটে পড়ে ইন্টারনেট ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহার কমে যাওয়ায় আমরা যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের দিকে যেতে চাই, তাতেও কি বিঘ্ন সৃষ্টি হবে না?

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর

 
Electronic Paper