ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ডাকাত সিন্ডিকেট মাদক কর্মকর্তার

অধিদফতরের গাড়ি নিয়েই ডাকাতি, ৩২০ ভরি স্বর্ণ লুটপাট, একচ্ছত্র প্রভাব মুন্সীগঞ্জে, টার্গেট তাঁতীবাজারের কারবারিরা

প্রীতম সাহা সুদীপ
🕐 ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২২, ২০২১

ডাকাত সিন্ডিকেট মাদক কর্মকর্তার

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মুন্সীগঞ্জ জেলার সহকারী পরিচালক (এডি) হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন এস এম সাকিব হোসেন ওরফে সাকিব শিকদার। কিন্তু উপ-পরিচালক পদে কেউ নিযুক্ত না থাকায় পুরো জেলার মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছিল তার হাতেই। এই দায়িত্বের আড়ালে একটি নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে তুলে একের পর এক স্বর্ণের চালান ডাকাতি করে আসছিলেন সাকিব।

সাকিব বাহিনীর মূল টার্গেট ছিল দেশের অন্যতম স্বর্ণের বাজার পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের স্বর্ণকারবারিরা। প্রথম অবস্থায় এই ডাকাতির কাজে ভাড়া করা গাড়ি ব্যবহার করতেন সাকিব। পরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মুন্সীগঞ্জ জেলা অফিসের জন্য সরকারি ডাবল পিকআপ ভ্যান বরাদ্দ পাওয়ার পর ওই পিকআপ দিয়েই স্বর্ণ লুটপাট করতেন এই মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা। মাঝে-মধ্যে ডাকাতির কাজে নিজের সংস্থার পোশাকটিও ব্যবহার করতেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাকিবের এই সিন্ডিকেট এখন পর্যন্ত ৩২০ ভরি স্বর্ণ লুটপাট করেছে। তার বিশ^স্ত সহযোগীরা হলেন- এএসআই মো. এমদাদুল, সিপাহী আমিনুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন এবং গাড়িচালক ইব্রাহিম শিকদার। আর সাকিবকে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ সোনা বহনকারী ব্যবসায়ীদের তথ্য দিতেন স্থানীয় একটি স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী জীবন পাল।

যেভাবে স্বর্ণ লুট করত সাকিব বাহিনী
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সিদ্দিকুর রহমান নামের মুন্সীগঞ্জের এক স্বর্ণ কারবারিকে টার্গেট করে সাকিব বাহিনী। ওইদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাঁতীবাজার থেকে ৯০ ভরি স্বর্ণ কেনেন সিদ্দিকুর। স্বর্ণগুলো ছিল বার আকারে। সিদ্দিকুরের কেনা ৯টি বারের প্রতিটির ওজন ছিল ১০ ভরি করে। তাঁতীবাজার থেকে মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর জিন্দাবাহার পার্ক এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয় দিয়ে সিদ্দিকুরের গতিরোধ করে এই চক্রটি। একপর্যায়ে ওই স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মুন্সীগঞ্জ জেলা অফিসের জন্য বরাদ্দ পাওয়া সরকারি ডাবল পিকআপ ভ্যানটিতে তোলা হয়। তার কাছে থাকা সব স্বর্ণ লুট করে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনের রাস্তায় তাকে ফেলে রেখে যায় চক্রটি। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন ওই ব্যবসায়ী।

এরপরই চক্রটির সন্ধানে মাঠে নামে পুলিশ। তদন্তের একপর্যায়ে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে জীবন পাল, রতন কুমার ও হারুন নামে তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত সোমবার জীবন ও রতন আদালতে জবানবন্দি দেন। এর পরই সাকিব শিকদারকে ভাটারা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গত মঙ্গলবার আদালতের নির্দেশে সাকিব, কনস্টেবল আমিনুল ও সোর্স হারুনকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।

এদিকে গ্রেফতার হওয়ার পর গত বুধবার আদালতে জবানবন্দি দেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মুন্সীগঞ্জ জেলা অফিসের ওই পিকআপ ভ্যানের চালক ইব্রাহিম। এএসআই এমদাদুল ও কনস্টেবল আলমগীরকে দুই দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন সাদবীর ইয়াসির আহসান চৌধুরীর আদালত।
সাকিব ও তার সহকর্মীদের এমন অপরাধমূলক কর্মকা-ে ব্রিবত মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। ওই পাঁচজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত ও বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়াও চলছে বলে জানা গেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) বিপ্লব বিজয় তালুকদার দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, স্বর্ণ ব্যবসায়ী সিদ্দিকুরের করা মামলাটি তদন্তাধীন। এরই মধ্যে আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন জবানবন্দি দিয়েছেন, পাঁচজন রিমান্ডে। সরকারি একটি সংস্থার কর্মীদের বিরুদ্ধে এই অপকর্মের অভিযোগ মিলেছে। তাই পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আগে এ বিষয়ে আর কিছুই বলতে চাচ্ছি না।

জবানবন্দিতে যা বলেছেন সাকিবের গাড়িচালক ও দুই সোর্স
গত বুধবার আদালতে দেওয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গাড়িচালক ইব্রাহিম শিকদার বলেছেন, সহকারী পরিচালক (এডি) এসএম সাকিব হোসেন ওরফে সাকিব শিকদার তাকে লোভ দেখিয়ে স্বর্ণ লুটপাটের এই অপকর্মে সম্পৃক্ত করেছেন। একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তার এ কাজ করা ঠিক হয়নি।

অন্যদিকে জীবন ও রতন তাদের জবানবন্দিতে বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরেই ভাগ হিসেবে স্বর্ণের বার পাওয়ার বিনিময়ে তারা মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সাকিবকে লুটপাটের কাজে সহায়তা করে আসছিলেন। কেউ তাঁতীবাজার থেকে অধিক পরিমাণে স্বর্ণ কিনলেই তাদের অনুসরণ করতেন স্থানীয় স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী ও সাকিবের সোর্স জীবন পাল। অনুসরণের একপর্যায়ে টার্গেট ব্যক্তিকে চক্রের অন্য সদস্যদের চিনিয়ে দিতেন তিনি। আর জীবনকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করতেন আরেক স্বর্ণের দোকানের কর্মচারী রতন।

২৩০ ভরি স্বর্ণ লুট করে চক্রটি
এদিকে জিজ্ঞাসাবাদে এএসআই আমিনুল পুলিশকে জানিয়েছে, ঘটনার সময় গাড়ি থাকলেও সে গাড়ি থেকে নামেনি। যা করার অন্যরা করেছে। যদিও সাকিবের সঙ্গে এই চক্রে দীর্ঘদিন ধরে এই পুলিশ কর্মকর্তা কাজ করছেন বলে জানা গেছে।

পুলিশ জানিয়েছে, সিদ্দিকুরের কাছ থেকে লুট করা ৯০ ভরি স্বর্ণের মধ্যে সাকিব নিজে নিয়েছেন ৫০ ভরি। আর বাকি স্বর্ণ ভাগ করে দিয়েছেন সহযোগী ও সোর্সদের মধ্যে। এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আরেক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২৩০ ভরি স্বর্ণ লুট করে চক্রটি।

 
Electronic Paper