ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রঙিন শীতলপাটির শিল্পীরা যাচ্ছে হারিয়ে

রিপন দাস
🕐 ৪:২৯ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০২১

রঙিন শীতলপাটির শিল্পীরা যাচ্ছে হারিয়ে

ঘন ঝোপঝাড় ঘেরা মেঠোপথ পেরিয়ে ছোট্ট একটা টিনের ঘর। সেই ঘরের দাওয়ায় বসে শীতল পাটি তৈরি করছিলেন বীরেশ দাশ। আপনমনে সুনিপুণ হাতের বাহারী রঙে ফুটিয়ে তুলছেন রঙের নকশা। সেই রঙের নকশা যেন পাটিতেই আটকে আছে। কেন না তার মনে ভর করে আছে রাজ্যের হতাশা। রাত-দিন পরিশ্রম করে আর্থিক সচ্ছলতা না আসলে মনে আনন্দ না থাকারই কথা। তবুও জীবিকার তাগিদে কোনোমতে আঁকড়ে আছেন বাপ-দাদার পেশা। কারণ অন্য কিছু করার যে সুযোগ নেই তার।

বহুদিন যাবত পাটি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করলেও নায্য মূল্য না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অনেকে এই পেশা ছেড়েছেন। তবে ঐতিহ্য হিসেবে বীরেশের মতো হাতেগোনা কিছু পরিবারে এখনো ঠিকে আছে পাটি শিল্প। টানাপোড়ন আর হতাশা যাদের ঘিরে আছে সবসময়।

২০১৭ সালে বাংলাদেশের শীতল পাটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। তবে এ ঘোষণা সত্ত্বেও ভাগ্য ফিরেনি শীতল পাটির শিল্পীদের। কাঁচামাল সঙ্কট ও নায্যমূল্য না পাওয়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন তারা।

বীরেশের বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি হাওর সংলগ্ন নিভৃত পল্লী পশ্চিম গগড়ায়।

সম্প্রতি পশ্চিম গগড়ায় গেলে কথা হয় বীরেশ দাসের সাথে।

তিনি বলেন, ‘২৫ বছর থাকি আমরা পাটি বানাইরাম কিন্তু এখন আর আগর মতো লাভ নাই, বেতও পাওয়া যায় না। বেতের দাম দিয়া পাটি বানাইয়া সংসার চালানি যায় না অন্য কোনো কাজ জানি না তাই এই কাজ করি। যারা কাজ পারেন লেখাপড়া শিখেছেন তারা চাকরি করছেন। বিদেশে গেছেন। তাদের পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে।’

তার কথার সাথে যোগ করেন আরেক পাটিশিল্পী মানিক দাস। দীর্ঘশ্বাসের সাথে তিনি বলেন, ‘আগে ১৬ আনা মানুষই কাজো আছিল, এখন আছে দুই আনা। অন্য কাম পাইলে আমিও ইতা করতাম না। সরকারি সহযোগীতা পেলে কিছু সচ্ছলভাবে আমরা কাজ করতে পারতাম।’

বীরেশ ও মানিকের মতো এই ইউনিয়ন ও পাশের দাসেরবাজার ইউনিয়নের বেশিরভাগ লোকই যুগ যুগ ধরে পাটি তৈরির কাজ করে আসছেন। বর্ণি ইউনিয়নের কিছু পরিবারেও পাটি তৈরি হত। তবে নানা সঙ্কটে অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। যারা জড়িত আছেন তাদের অবস্থাও খুব একটা ভালো না।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার দাসেরবাজার পূর্ব ও দক্ষিণ লঘাটি, পানিশাওয়া, গুলুয়া, গোবিন্দপুর, ওহির কুঞ্জি, বাগিরপার, টুকা, মহানারী, কান্দিগ্রাম, মালিশ্রী, বর্ণি ইউনিয়নের মিহারী, কান্দিগ্রম, উজিরপুর, তালিমপুর ইউনিয়নের গগড়া, বড় ময়দান, দ্বিতীয়ারদেহীসহ অধিকাংশ গ্রামের হিন্দু পরিবার এই শিল্পের সাথে জড়িত ছিলো। তবে এখন বেশিরভাগ পাটি শিল্পীর এ কাজের প্রতি অনীহা দেখা দিয়েছে।

এক সময় এই এলাকাগুলোতে তৈরি হতো নানা ধরনের পাটি। তবে নানা সংকট সত্ত্বেও প্রাণের টানে কিছু পাটি শিল্পী বাঁচিয়ে রেখেছেন পূর্বপুরুষের এ শিল্প। একসময় এ অঞ্চলের অনেকেরই প্রধান পেশা ছিল পাটি তৈরি করে বিক্রি করা। কিন্তু বাজারজাতকরণে সমস্যা, প্রকৃত মূল্য না পাওয়া এবং মূলধন সংকটের কারণে এ শিল্পের প্রতি তাদের অনীহা সৃষ্টি করেছে।

যেভাবে তৈরি হয় পাটি : মুর্তা নামক এক প্রকার সরু গাছের ছাল দিয়ে এই পাটি তৈরি করা হয়। গাছ কেটে ধারালো দা বা বটি দিয়ে গাছটিকে লম্বাভাবে ৪/৫ টুকরো করে গাছের ছাল বা বেত বের করা হয়। অতঃপর এক ঘন্টা বেতগুলো টিনের পাত্রে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পরে সেদ্ধ করার পর তুলে এনে রোদে শুকিয়ে পুনরায় ঠান্ডা ও পরিষ্কার পানিতে ১০/১৫ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে ধুয়ে তোলা হয়। এরপরই মুর্তা বেত পাটি তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহারযোগ্য হয়। বেতে রং দিয়ে পাটিকে নানা চিত্রে সাজিয়ে আরও আকর্ষণীয় করা হয়।

পাটির ব্যবহার : সাধারণত মুর্তা বেতের তৈরি শীতল পাটি কিংবা অন্যান্য জাতের সকল প্রকার পাটি গরমের দিনে বিছানার উপর ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা অনুষ্ঠান- যেমন বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধে নতুন পাটির ব্যবহার অপরিহার্য। বিবাহে কন্যাদানের সময় পিতা-মাতা অন্যান্য নানা সামগ্রীর সাথে একখানা শীতলপাটি বা নকশি করা রঙ্গিন পাটি উপহার দিয়ে থাকেন।

জানা যায়, একসময় দাসেরবাজারের তৈরি রূপালী বেতের শীতল পাটি নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ সম্রাট আওরঙ্গজেবকে উপহার দিয়েছিলেন। এসব পাটি ধনী-গরিব সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করতেন, যা স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব।

আধুনিক প্লাস্টিকের তৈরি মাদুর স্বাস্থ্যসম্মত না হলেও পাটির বিকল্প হিসেবে বাজার এটি সয়লাব হয়েছে। এতে পাটির কদর কমেছে পাটির নাম, তৈরির সময়কাল ও দাম : মুর্তা বেতের পাটি বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন-শীতল পাটি, রঙ্গিন বেতের পাটি, সরু বেতের পাটি, প্রার্থনা কিংবা উপাসনার জন্য কমল-কোষ পাটি ইত্যাদি। সাড়ে ৩ হাত ও পৌনে ৫ হাত মাপের একটি সাধারণ পাটি তৈরি করতে ৭-৮ দিন সময় লাগে। বিক্রি হয় ১ হাজার থেকে ১২শ' টাকায়। ৪ থেকে ৫ হাত একটি পাটি তৈরি করতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ দিন। দাম পাওয়া যায় ২ হাজার টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকা।

পাটির হাট: বিভিন্ন বাড়ি থেকে তৈরি পাটি পুরুষ সদস্যরা বাজারে বিক্রির জন্য আসেন। বড়লেখা উপজেলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দাসেরবাজারে নানা জাতের পাটির বিশাল হাট বসে প্রতি বৃহস্পতিবার ও রোববার। দাসেরবাজার ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন বাজারে ফেরি করে বিচ্ছিন্নভাবে পাটি বিক্রি করেন অনেকে।

স্থানীয় তালিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ কান্তি দাস বলেন, ‘এখানে আদিকাল থেকে পাটি তৈরি হচ্ছে। ৫ থেকে ৭ বছর ধরে এর কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। আগে এক সপ্তাহে একটি পাটি তৈরি ৮০০-১০০০ বিক্রি করলে সংসার চলত। এখন ২ হাজার টাকা বিক্রি না করলে পোষায় না। কিন্তু মানুষ ২ হাজার টাকা দিয়ে কিনতে চায় না। এছাড়া চাহিদা অনুযায়ী মূর্তা পাওয়া যায় না। চড়া দামে বেত কিনতে হয়। কিন্তু বিক্রি করতে হয় কম দামে। এই জন্য পাটি তৈরিতে মানুষ নিরুৎসাহিত হয়েছেন। হাতেগোনা কিছু মানুষ তৈরি করেন। এ শিল্পে ভর্তুকির ব্যবস্থা করলে মানুষ এ কাজে আবার ফিরবে।’

বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শামীম আল ইমরান বলেন, ‘এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে যতটুকু সহযোগীতা করা দরকার করা হবে। তাদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার পাশাপাশি পণ্যগুলো বাজারজাত করার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। যাতে তারা ন্যায্য মূল্য পায়।’

 
Electronic Paper