ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘গুম করাই ছিল উদ্দেশ্য’

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২০

অপহরণ করে গুম করার উদ্দেশ্যে আমাকে গ্রেফতারের নাটক সাজানো হয়েছিল। আর এই নাটক সাজিয়েছেন বন কর্মকর্তা মান্নান। গাজীপুরে সালনা বন বিটে যোগ দেওয়ার পর থেকেই ফরেস্টার মান্নান আমাদের লিজপ্রাপ্ত জায়গায় তৈরি বসতবাড়িতে এসে চাঁদা দাবি করেন। আমরা টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় তিনি আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ হন।

এরপর উচ্ছেদ করার জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন শুরু করেন। টাকা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি নাটক সাজিয়ে আমাকে অপহরণ ও গুম করার চেষ্টা চালান। কিন্তু জানাজানি হয়ে যাওয়ায় সামাল দিতে না পেরে আমাকে গ্রেফতার দেখিয়ে মামলা দিয়ে আদালতে হাজির করেন। আদালত আমাকে জেলে পাঠানোর আদেশ দেন। এ কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুরের হাতিয়াব মৌজার সিএস ১৮০ দাগে লিজপ্রাপ্ত এবং সেখানে ঘর তুলে বসবাসকারী আবুল কাশেম। 

বন বিভাগ সূত্র জানায়, গত ২৩ আগস্ট সকালে আবুল কাশেমকে গ্রেফতার করা হয় বনের গাছ কাটার অভিযোগে। তাকে গ্রেফতার করেন ফরেস্টার, সালনা বিট ও স্টেশন কর্মকর্তা মো. আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে বনপ্রহরী মো. আশরাফুল ইসলাম এবং তার সঙ্গীরা। ষাট বছর বয়সী কাশেমকে লোহার শিকল পরিয়ে প্রথমে নেওয়া হয় সালনা বিট অফিসে। সেখানে তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে গাজীপুর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বন আদালতে হাজির করা হয়। মামলা নং ৫৯/২০২০, তারিখ ২৩/০৮/২০২০। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে আবুল কাশেমের বয়স ও অসুস্থতা বিবেচনায় আদালত গত ৩ সেপ্টেম্বর তাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন।

জামিনে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কাশেম বর্তমানে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

এ প্রসঙ্গে আবুল কাশেম বলেন, ‘ফরেস্টার মান্নান ইতিপূর্বেও তার লোকজন নিয়ে এসে কয়েকবার আমাকে আমার ঢাকার বাসা থেকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে উত্তর শাহজাহানপুরে আমার বাসায় জোরপূর্বক ঢুকে চাঁদা দাবি করেন। আমি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে দরকারি কাগজপত্র ও নগদ টাকা নিয়ে নেন। এক পর্যায়ে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানাটানি শুরু করেন। এসময় আমার স্ত্রী-সন্তানের চেঁচামেচিতে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে তারা আমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে দ্রুত চলে যান। এই ঘটনার পর আমি সিএমএম কোর্টে রেঞ্জার আবুল বাশার, বিট কর্মকর্তা আবদুল মান্নান, বনপ্রহরী দেলোয়ার ও বনের দালাল রাজ্জাক ওরফে লিলি, শহীদুল্লাহকে আসামি করে ধারা ৪৪৮/৩২৩/৩২৪/৩৮৫/৩৮৬/৩৪ পেনাল কোডে মামলা দায়ের করি। মামলা নং সিআর ৩১/২০, তারিখ ১৩/০২/২০২০। মামলাটি বর্তমানে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন অব ব্যুরোতে (পিবিআই) তদন্তাধীন আছে। এই মামলা এবং চাঁদা না পাওয়ার জের হিসেবেই মান্নান ক্ষুব্ধ হয়ে পরিকল্পিতভাবে আমাকে গুম করার উদ্দেশ্যে গত ২৩ আগস্ট গ্রেফতারের নাটক সাজান।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাতিয়াব মৌজার একজন বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা যারা অবৈধভাবে আছি তাদের প্রত্যেককেই মাসিক চাঁদা দিতে হয়। কিন্তু লিজপ্রাপ্ত আবুল কাশেম চাঁদা না দেয়ায় ফরেস্টার আব্দুল মান্নান তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছেন শুরু থেকেই। তাকে বিভিন্নভাবে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন আমার মতো অবৈধ বাসিন্দা শহীদুল্লাহ, রাজ্জাক ওরফে লিলি, সফিক, আনোয়ার মেম্বার, মনির প্রমুখ। এই এলাকায় যখন যে ফরেস্টার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে এসেছেন তাকেই তারা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে চাঁদাবাজির সুবিধা করে দিয়েছেন।

বলা যায়, এরা বনের নিয়মিত দালাল। এই দালালরাই কাশেম গ্রেফতার হওয়ার আগের দিন রাতে লোকমানের বাড়িতে বসে নাটক সাজান। তাদের সহযোগিতা করেন জয়নাল, জয়নালের স্ত্রী ও পুত্র জিয়ন, মাহবুব এবং মনির। তারাই সংঘবদ্ধ হয়ে কাশেমের লিজপ্রাপ্ত জমিতে কাশেমেরই লাগানো গাছ গত ২২ আগস্ট রাতে কেটে ফেলেন মান্নানের ইশারায়। আর এই গাছ কাটার অভিযোগ আনা হয় কাশেমের বিরুদ্ধে এবং তাকে ফাঁসানো হয়। কয়েকজন বনপ্রহরীসহ মান্নান সিএনজি অটোরিক্সা নিয়ে আগেই হাজির হন ১৮০ দাগের জমির পাশের রাস্তায়। অন্যদিকে কে গাছ কেটেছে জানতে চেয়ে কাশেমকে তার ঘর থেকে ডাকা হয়। কাশেম ঘুমঘুম চোখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে ফরেস্টার মান্নান ও বনপ্রহরীরা তাকে ধরে সিএনজি অটোরিক্সায় তুলে নিয়ে চলে যান।’

তিনি বলেন, ‘কাশেমের স্ত্রী বিষয়টি থানায় জানান। থানা পুলিশ জেনে যাওয়ায় বনের লোকজন তাকে গুম না করে সালনা বিট অফিসে নিয়ে যান। সেখানে জোরপূর্বক কাশেমের স্বাক্ষর নিয়ে গাছ কাটার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করেন। তার কোমর, হাত ও পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে প্রহার করতে করতে নিয়ে যাওয়া হয়। তার আর্তনাদে অনেকে এগিয়ে এলেও প্রতিবাদ করার সাহস কারো হয়নি।’

কাশেম বলেন, ‘ফরেস্টার মান্নান স্থানীয় কতিপয় সাংবাদিককে ভুল তথ্য দিয়ে সংবাদপত্রে অসত্য সংবাদ প্রকাশ করান। এসব সাংবাদিকদের অনেকেই ঘটনাস্থলে না এসে শুধু তাদের বক্তব্য নিয়ে একতরফাভাবে স্থানীয় ও জাতীয় কয়েকটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ করেন। সে সব সংবাদে আমার কোনো বক্তব্য নেই, আমাকে কিছু জিজ্ঞাসাও করা হয়নি।’

আবুল কাশেম বলেন, ‘একটি দৈনিক পত্রিকা গত ২৪ আগস্ট লিখেছে আমি অপকৌশলে বনের জমি লিজ নিয়েছি। আমি কুখ্যাত বনদস্যু, বনের তিনটি মামলায় ফেরারি। প্রথমত, ওই পত্রিকা স্বীকার করেছে আমি লিজপ্রাপ্ত। যেহেতু আমি লিজপ্রাপ্ত সেহেতু ২০১৩ সাল থেকেই আমি এখানে বসবাস করি। এমনকি যে গাছ কাটার অজুহাতে আমাকে গ্রেফতার করা হয় সে গাছগুলো আমারই লাগানো। অথচ জমিটি কোনোকালেই বনের ছিল না, এখনো বনের নয়। এটা ভাওয়াল রাজ স্টেটের জমি। এখন এটি আছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তারাই প্রজ্ঞাপন জারি করে লিজের প্রস্তাব দেয়। আমি শুধু ৮৬ জন আগ্রহী সদস্য নিয়ে আবেদন করে ভূমি মন্ত্রণালয়ের শর্ত পূরণ করে লিজপ্রাপ্ত হই। কিন্তু জমিতে গেলে বনের লোকজন আমাদের কাছে এসে চাঁদা দাবি করেন। বৈধ লিজ গ্রহীতা হওয়ায় আমরা কোনো সময়ই কাউকে চাঁদা দেইনি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি শুরু করেন বন কর্মকর্তারা। যখন যে কর্মকর্তা সালনা বিটে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে এসেছেন তিনিই এসে চাঁদা দাবি করেছেন এবং আমাকে ও আমার পরিবারকে হয়রানি করেছেন।’

এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত ফরেস্টার ও সালনা বিট কাম স্টেশন কর্মকর্তা আব্দুল মান্নানের সঙ্গে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে এসব তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ বলে জানান। তারপর কাশেমকে অপহরণ ও তার লিজপ্রাপ্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সুকৌশলে তা এড়িয়ে যান। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয় এড়িয়ে গিয়ে তিনি অপ্রাসঙ্গিক একতরফা বক্তব্য দিতে থাকেন। তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

 
Electronic Paper