ঝোপজঙ্গলের গ্রাম
শাকিল মুরাদ, শেরপুর
🕐 ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২০
পাহাড়ের উঁচু থেকে অঝোরে ঝরছে জল। এ জলের শান্ত শীতল স্রোতধারা বয়ে চলেছে একটানা। পরিণত হয়েছে অসাধারণ ঝরনায়। যার মোহনা পাগলা নদীতে। সহজ সরল এ নদীর বুকে জেগে উঠেছে চর। চরে চকচক করছে বালু।
পাশেই টিলা। ঝরনা, নদী আর সৌন্দর্যে অপরূপ পাহাড়ি লীলাভূমি। যেন ঐশ্বরিক স্বপ্নপুরি। এটির কূল ঘেঁষে নানা কারুকার্যে সাজানো উপজাতি এলাকা। গারো পাহাড়ের নিঝুম অরণ্য ঘেরা এলাকার নাম বাবেলাকোনা ও হারিয়াকোনা। আদিবাসীদের বসবাসে গ্রামটিতে যোগ হয়েছে সৌন্দর্যের নতুন মাত্রা। ঝরনার দুপাশে সবুজ বৃক্ষ।
এ যেন হাতে বোনা সবুজের কারুকাজ। আর সেই সবুজে আচ্ছাদিত কারুকাজের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য উঁচু-নিচু পাহাড়। চারপাশে এত এত সৌন্দর্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও তেমন কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি গ্রাম দুটিতে। যোগাযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় রয়েছে কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা। কৃষিপ্রধান অঞ্চলে পৌঁছেনি উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিক যন্ত্রপাতি। কৃষি কর্মকর্তা বলে কিছু আছেÑ জানেন না গ্রামবাসী।
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পোড়াকাশিয়া। এর পাশেই শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার গারো পাহাড়ের শেষ গ্রাম হারিয়াকোনা। পাহাড়ের চূড়ায় তৈরি ঘরবাড়িকে দূর থেকে মনে হবে আকাশ ছোঁয়া কুটির। এলাকার ৮৫ শতাংশ লোক কৃষির ওপর নির্ভরশীল। স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি, নেই কোনো স্বাস্থ্যসেবা। বিদ্যুৎ নেই। স্যানিটেশন ও শিক্ষা ব্যবস্থাও নাজুক। গ্রামের মানুষগুলোর দিন কাটে খুব কষ্টে। অভাব-অনটন তাদের নিত্যসঙ্গী। এরই মধ্যে সহ্য করতে হয় ভারতীয় বন্যহাতির তাণ্ডব। ইতোমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছে শতাধিক লোক। ধ্বংস হয়েছে ঘর, ফসলের খেত। হাতির ভয়ে রাতের ঘুমও যেন হারাম হয়েছে গ্রামবাসীর।
এদিকে জেলা শহর থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরের গ্রাম হারিয়াকোনা। এর আড়াই কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথ। চলে না যানবাহন। কথিত আছে, কেউ একবার যে পথে গ্রামটিতে গিয়েছে সে পথ ধরে আর ফিরে যেতে পারেনি। এ কারণে গ্রামটির নাম হয়েছে হারিয়াকোনা। এ গ্রামের উত্তর ও পূর্বে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পোড়াকাশিয়া। দু’দেশের সীমানা পিলার নম্বর ১০৯৩/১০৯৪। পশ্চিমে দিঘলাকোনা। দক্ষিণে বাবেলাকোনা। প্রায় চার কিলোমিটার ব্যাসার্ধের গ্রামটিতে রয়েছে প্রায় অর্ধশত টিলাভূমি। টিলার ওপরেই তৈরি হয়েছে বসতবাড়ি। চার শতাধিক গারো, কোচ, হাজং পরিবারের বসবাস এখানে। গ্রামটিতে রয়েছে গীর্জা, জিবিসি পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফুটবল খেলার মাঠ, কয়েকটি মুদি ও চায়ের দোকান। কিন্তু হারিয়াকোনার মত এখানেও লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া।
সম্প্রতি সরেজমিনে গেলে কথা হয় শ্রীবরদী ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমার সঙ্গে।
তিনি বলেন, যোগাযোগব্যবস্থা খারাপের জন্যে আমরা প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। এখানকার উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে উৎপাদনের লাভের অংশ পরিবহন খাতে খরচ হচ্ছে। এ কারণে উৎপাদন আশাতীত লাভ পাচ্ছেন না তারা। তিনি আরও বলেন, এই বাবেলাকোনা ও হারিয়াকোনার কেউ অসুস্থ হলে গাছের পাতা, শিকড়, কবিরাজ ও ঝাড়ফুঁকই একমাত্র ভরসা। চিকিৎসা নিতে হলে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে উপজেলা সদরের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে হয়।
অনেকের সামর্থ্য না থাকায় চিকিৎসা সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। হারিয়াকোনা গ্রামের কৃষকরা আজও চাষবাদ করেন মান্দাতার আমলের পদ্ধতিতে। সেই আমলের কৃষিজ্ঞান ও উপকরণই তাদের সম্বল। কৃষি কর্মকর্তা বলে কিছু আছে এটা যেন তাদের কাছে অবিশ্বাস্য। বিগত বছরে যারা ভালো ফলন পেয়েছেন তাদের পরামর্শে ধান চাষের পাশাপাশি আদা, হলুদ, শিমুল আলু, আম, কাঠাল, লিচু, কলা, সুপারি, আনারস, কচু, বেগুন ও শসাসহ বিভিন্ন শাকসবজি চাষ করছেন তারা।
শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, বাবেলাকোনা ও হারিয়াকোনা সরকারের সব ধরনের উন্নয়ন করা হচ্ছে পাশাপাশি ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আদিবাসী কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি সম্পর্কে দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে।