ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

লোকজ মেলায় বাংলার ঐতিহ্য

এম কামরুল ইসলাম, সোনারগাঁ
🕐 ১০:২৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৪, ২০২০

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প মেলায় চলছে মাসব্যাপী লোকজ উৎসব। গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে যুগ যুগ টিকিয়ে রাখতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। তবু যেন প্রযুক্তির কাছে হার মানছে বিভিন্ন ধরনের কারুপণ্য।

একসময় এসব পেশার সঙ্গে জড়িতরা এ পেশার মাধ্যমেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্তমানে দেশের কোনো অঞ্চলেই শিল্পের কারুকার্য ও নকশার কাজে শিল্পীদের ব্যস্ততা আগের মতো চোখে পড়ে না। প্রযুক্তিনির্ভর নিত্যনতুন পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে না পেরে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কারুপণ্য আজ বিলীন হওয়ার পথে। তবু বাপ-দাদার এ পেশাকে ধরে রাখতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন কারু শিল্পীরা।

সরেজমিন গত বৃহস্পতিবার মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, দেশের ৬৪ জেলা থেকে বাছাই করা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পীদের জন্য মেলার মাঠের মধ্যখানে ৩২টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। স্টলে বসেই শিল্পীরা মনোযোগের সঙ্গে বিভিন্ন জিনিসের ওপর কারুকর্ম করে যাচ্ছেন। কেউ কাঠের তৈরি জিনিসের ওপর নকশা করছেন, কেউ মাটির তৈরি শিল্পের ওপর রঙ ও নকশা করছেন। আবার কেউ কেউ হাতপাখায় নকশা ওঠাচ্ছেন, কেউ শীতল পাটি বুনছেন, কেউ জামদানি শাড়ি বুনছেন আবার কেউ শোলা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করছেন।

রাজশাহীর শখের হাঁড়ির কর্ণধার সুশান্ত কুমার পাল বলেন, মাটির তৈরি তৈজসপত্রে বাঙালির প্রাণ ছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা হতো এসব পণ্য; কিন্তু নানা আগ্রাসনের কারণে আজ দেশীয় সব শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতাই মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। তা না হলে এই শিল্প বিলীন হয়ে যাবে।

শোলা শিল্পের শিল্পী নিখিল মালাকার বলেন, একসময় অনেকেই এই পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সারা দেশে আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে সবাই অন্য পেশায় চলে গেছে। আমার পরিবারের ১১ জন সদস্য সকলেই শোলার পণ্য তৈরি করতে পারে। আমার বাবা শঙ্কর মালাকার বাব-দাদার আমল থেকেই এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

আজ বয়সের কারণে চোখে চশমা দেওয়া ছাড়া কিছুই দেখেন না। লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে মাসব্যাপী মেলায় সম্মানী দেয়। কিন্তু এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজন যদি স্বাবলম্বী না হতে পারে তাহলে একসময় বন্ধ হয়ে যাবে এই পরিবেশবান্ধব শিল্প। সরকারি উদ্যোগে রাজধানী ঢাকায় আমাদের একটি জায়গা নির্ধারণ করে সারা বছর বসার ব্যবস্থা করলে ভালো হতো, যেখানে বিদেশি পর্যটকদের পণ্য কেনার সুযোগ তৈরি করতে পারলে আমরা লাভবান হব। এতে শিল্পীরা বাঁচবে, অন্যদিকে দেশও লাভবান হবে। সরকারের কাছে অবসরকালীন ভাতার আবেদন করেন এই কারু শিল্পীরা।

কাঠের হাতী ঘোড়ার কারুশিল্পী বীরেন্দ্র চন্দ্র সূত্রধর বলেন, সোনারগাঁয়ের কাঠের হাতি ঘোড়া সারা বিশ্ব জয় করে এসেছে। ২০১১ সালে জাপান, ২০১৯ সালে নেপাল জয় করেছে। এখনো এই শিল্পের কদর রয়েছে।

এ বছর মেলায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন কারু পণ্যের পসরা বসেছে। ঝিনাইদহ ও মাগুরার শোলাশিল্প, ঢাকার মৃৎশিল্প, কিশোরগঞ্জের টেপাপুতুল, রাজশাহীর কাগজের শিল্প, ঠাকুরগাঁওয়ের বাঁশ ও বেতশিল্প, রাজশাহীর মুখোশ, সোনারগাঁয়ের জামদানি, পাটের কারুশিল্প, নকশি হাতপাখা ও নকশিকাঁথা, চট্টগ্রামের পাখা, রংপুরের শতরঞ্জি ও হাতপাখা, মুন্সীগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের শীতল পাটি শিল্প, ঢাকার তামা-কাসা ও পিতলের কারুশিল্প, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কারুপণ্য, কিশোরগঞ্জের টেরাকোটা শিল্প, নাটোরের মুখোশ শিল্প ইত্যাদি এ মেলায় স্থান পেয়েছে।

রাজশাহী থেকে বায়োস্কোপ নিয়ে মেলায় এসেছেন আবদুল জলিল। হেলেদুলে গানের মাধ্যমে মানুষকে বায়োস্কোপ দেখতে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি দুই যুগ আগে এ পেশায় জীবন-জীবিকার কাজ শুরু করলেও এখন আর কেউ বায়োস্কোপ দেখতে চায় না। তারপরও প্রতি বছর মেলায় আসতে হয় কেবল মানুষের ভালোবাসার টানে।

নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল থেকে ঘুরতে আসা নিশাত তাসনিম বলেন, প্রতি বছরই এই মেলা ঘুরতে আসা হয়। গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া কারুপণ্য এখানে পাওয়া যায়। এ বছর মেলা থেকে শোলার শিল্পের খুবই সুন্দর তিনটি ফুলমালা ক্রয় করেছি ১৫০ টাকায়।

সরমালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থী ফারহানা আক্তার ও সামিয়া রহমান বলেন, এখানে প্রথম এসেছি। কারুশিল্পের অনেক পণ্য এর আগে দেখিনি, এখন সরাসরি দেখছি।

ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক রবিউল ইসলাম খোলা কাগজ প্রতিবেদকে জানান, দেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কারু শিল্পীদের মাসব্যাপী মেলায় স্থান দেওয়া হয়েছে। নতুন প্রজন্মের দর্শনার্থীদের সঙ্গে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কারু শিল্পকে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই হলো লোকজ মেলার মূল উদ্দেশ্য। অসহায় শিল্পীদের অবসরকালীন ভাতার জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

 
Electronic Paper