ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দুই ঋতুর হাওর

সাজন আহম্মেদ পাপন, কিশোরগঞ্জ
🕐 ৫:৩৬ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২০, ২০১৯

মাটির ওপর জলের বসতি, জলের ওপর ঢেউ, ঢেউয়ের সাথে পবনের পিরিতি, নগরে জানে না কেউ...। অপূর্ব সুন্দর এক জনপদ হাওর। শুকনো মৌসুমে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, মেঠোপথ আর নদী। বর্ষায় নদীগুলোই ফুঁসে ওঠে। দুই তীর ছাপিয়ে প্লাবিত করে ফসলি মাঠ। দেখতে একেবারে সাগরের মতো। ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে হাওরের সৌন্দর্য অন্যান্য এলাকার চেয়ে একটু ভিন্ন। ব্যতিক্রম এখানকার ঋতুবৈচিত্র্য।

হাওরে বর্ষা থাকে বছরের প্রায় ছয় মাস। পানি আসতে শুরু করে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে। শেষ হয় আশ্বিন-কার্তিকে। বাকি কয় মাস এখানে শুকনো মৌসুম। সে হিসেবে মূলত হাওরে ঋতু দুটি। একটি বর্ষা, অন্যটি শুকনো। কথিত আছে, বৃহত্তর সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের একটি বড় অংশ এক সময় কালীদহ সাগর নামে বিশাল জলরাশিতে নিমজ্জিত ছিল। পরবর্তীতে ভূ-প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে তা পিরিচ আকৃতির নিম্ন সমতলভূমিতে পরিণত হয়। এ নিম্ন সমতলভূমিই এখন হাওর। হাওর শব্দটিও সাগর শব্দের অপভ্রংশ। সাগর থেকে সায়র, সায়র থেকে হাওর।

রাতে হাওরের মাঝখানে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় কুপি জ্বালিয়ে জেলেরা যখন জাল দিয়ে মাছ ধরে, এ দৃশ্য দূর থেকে দেখলে মনে হয় কারা যেন শত শত প্রদীপ জ্বালিয়ে হাওরের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে। রাতভর হাওরে ভেসে ভেসে জোসনা উপভোগ করাটা আনন্দের বিষয়। অভিলাষী মনকে জোসনায় ঠাঁই দেওয়ার এমন সুযোগ হাওর ছাড়া আর কোথায় আছে! যোজন হাওরে ট্রলারের ছাদে বসে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখাটাও সৌভাগ্যের ব্যাপার বটে। এখানে হিজল করচের মাথা ছুঁয়ে সূর্য যখন ডুবে, দিগন্তজুড়ে হাওরের পানি লালে লাল হয়ে যায়। সূর্যের লাল-সোনালি-হলুদ আলো লেজার রশ্মির মতো রেখা ছড়িয়ে দেয় পুরো আকাশজুড়ে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য!

মাঝে মাঝে হাওরের প্রকৃতি অবশ্য ভয়াবহ রূপ নেয়। বাতাস ছুটলে হাওরের পানিতে ঢেউ ওঠে প্রচণ্ড। এসময় চলাচলকারী নৌকাগুলোকে তীরে এসে আশ্রয় নিতে হয়। না হয় হিজল গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখতে হয়। বাতাস দীর্ঘস্থায়ী হলে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর। এ সময় বাড়িঘর ভাঙতে থাকে। হাওরের লোকেরা এ দুর্যোগকে বলে আফাল। এ আফাল থেকে ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হয় হাওরবাসীকে। ভাঙন প্রতিরোধে বাঁশ, কচুরিপানা বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদ দিয়ে বাড়ির চারপাশে নির্মাণ করতে হয় শক্ত বাঁধ। স্থানীয় ভাষায় এটাকে বলে ঘায়েল। রাত জেগেও ঘায়েল পাহারা দেয় গ্রামবাসী।

এখন অনেক গ্রামেই সরকারিভাবে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। বর্ষা পরবর্তী শরতে হাওরে যখন পানি কমা শুরু হয় তখন থেকেই আকাশে সাদা মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে হাজার হাজার ধবল বকেরও উড়াউড়ি শুরু হয়। দুলতে থাকে হাওরপাড়ের সাদা কাশবন। আসতে শুরু করে পরিযায়ী পাখি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিলে ফুটে সাদা শাপলা, রক্ত শাপলা, নীল শাপলা ও চাঁদমালা ফুলেরা! এরপর শুকনো মৌসুমে পুরো হাওর হয়ে যায় দিগন্তবিস্তৃত সবুজ প্রান্তর।

এ বর্ষায় দুদিনের জন্য ঢাকা থেকে হাওরে ঘুরতে এসেছিলেন ছড়াকার জগলুল হায়দার, রাজশাহী থেকে এসেছিলেন শিল্পী জিপসি রাসু, চট্টগ্রাম থেকে এসেছিলেন গীতিকার নবাব আমিন। কথা হয় তাদের সঙ্গে। নবাব আমিন জানান, হাওরে না এলে বুঝতাম না প্রকৃতির ভাঁজে ভাঁজে দয়াময় প্রভু এত সৌন্দর্য লুকিয়ে রেখেছেন।

জিপসি রাসুর মন্তব্য, হাওরে এলে বাড়ি যেতে আর মন চায় না। এখানকার সৌন্দর্য বিরহী মনকে আনন্দিত করে। জগলুল হায়দার বলেন, হাওরের বুক যেমন বিশাল এর সৌন্দর্যটাও তেমন। এখানে এলে কবিমন আন্দোলিত হয়।

চীনের বিখ্যাত পর্যটক হিউয়েন সাং থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের বিখ্যাত পর্যটকেরা হাওরের প্রকৃতি, প্রাচীন স্থাপনা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। মুগ্ধ হয়েছেন হাওরের মানুষের জীবনযাপন, কৃষ্টি-কালচার ও উদার আতিথেয়তায়।

 
Electronic Paper