বঞ্চনায় বেড়ে উঠছে যৌনপল্লির শিশুরা
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি
🕐 ৯:৪৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০৩, ২০২২
আজ বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ শুরু। এ বছরের জাতীয় কন্যা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সময়ের অঙ্গিকার, কন্যা শিশুর অধিকার’। সারাদেশে পালিত হবে বিশ্ব শিশু দিবস। একই সাথে শিশুর অধিকার, সুরক্ষা এবং শিশুর উন্নয়ন ও বিকাশে সংশ্লিষ্ট সকলকে অধিকতর উদ্যোগী ও সচেতন করার লক্ষ্যে ৪ থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত পালন করা হবে শিশু অধিকার সপ্তাহ।
বিশ্ব শিশু দিবসে কেমন আছে দেশের সর্ববৃহৎ যৌনপল্লির শিশুরা।এখানে শিশুদের পড়ার পরিবেশ নেই। ছোট ছোট রুম। সেখানে মায়েদের যৌন ব্যবসা। অলি-গলিতে মদের দোকান, নাচানাচি ও চিৎকার চেঁচামেচি। ঘরে জায়গা না পাওয়ায় রাস্তায়, ফুটপাতে কিংবা ‘মাসি’র ঘরে দিনাতিপাত করে যৌনজীবী মায়ের অবোধ শিশুরা। অথবা মুক্তি মহিলা সমিতির শিশু কেন্দ্র এবং কেকেএস এর সেফ হোম।
জীবন এখানে মলিন আর অনিশ্চয়তায় ভরা। এখানে তাদের জন্ম হয় অন্ধকার কুঠরীতে। জন্মের পর বেড়ে উঠে সেই অন্ধকার গলিতে। এখানে মায়া নেই, মাঝো মাঝে দুধের পরিবর্তে শৈশবে মুখে ঢেলে দেওয়া হয় মদ। জীবনের গল্পটা শুধুই অন্ধকারে ভরা। যেখানে রঙিন ঝলসানো রাতে রঙিন পানীয় দেখে বেড়ে উঠে শিশুরা।
যে বয়সে শিশুরা মায়ের কোলে বসে ঘুম পাড়ানি গান শুনে ঘুমিয়ে যায় সেই বয়সে অনেক কে আশ্রয় নিতে হয় আশ্রয়ন কোন প্রকল্পে বা মায়ের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে রেখে দেন যৌনপল্লীর বাহিরে কারো বাড়িতে । মা বাবা থাকার পর থাকতে হয় অভিভাবকহীন। এতে শিশু বয়সেই মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পরে।
দেশের বৃহত্তম রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে বড়দের পাশাপাশি শিশু-কিশোররা মাদক ব্যবসা ও সেবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বাবা মায়ের আদর বঞ্চিত এসব শিশুরা এই পরিবেশে বড় হওয়ার কারণেই মুলত তারা এসব পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া বাইরের জগতের কাজের ধারণা তাদের কম। তাছাড়া শটকার্ট টাকা উপার্জনের কারণে ও অনেকেই জড়িয়ে পড়ে এই পেশায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া বেশির ভাগ শিশু-কিশোররাই বর্তমানে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। এছাড়া চুরি, ছিনতাই, নারী পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তারা। বাইরের প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী ও নারী পাচারকারীরা তাদের এ ব্যবসায় নামিয়ে নিজেরা ফায়দা লুটছে বলেও একাধিক সূত্রে জানা যায়।
যৌন পল্লীরর ভিতরে বর্তমানে প্রায় অর্ধশত মদের দোকান, শতাধিক গাঁজার দোকান ও ভাসমান হেরোইন, ফেনসিডিল ব্যবসায়ী প্রশাসনের চোখের সামনেই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ব্যবসা। পাশাপাশি অনেক প্রভাবশালী বাড়িওয়ালারাও মাদক বাণিজ্যে পল্লীর শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করে টাকার পাহাড় গড়ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রতিদিন সড়ক ও রেলপথে নানা ধরনের মাদক দ্রব্য যৌনপল্লীতে চলে আসে। এর বাইরে স্থানীয় সরকারি লাইসেন্সধারী মদের ডিলার হিসেবের মারপ্যাঁচে প্রতিদিন শত শত লিটার মদ যৌনপল্লীতে সরবরাহ করছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এ ব্যবসা চললেও অজ্ঞাত কারণে বিষয়টি তাদের নজরে আসছে না। স্থানীয় একটি চক্র এ ব্যবসা থেকে প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকার মাসোহারা আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এভাবে বৈধ দোকানে অবৈধ মদ সরবরাহের কারণে পল্লীর ভেতরে অন্তত্য শতাধিক শিশু-কিশোর মাদক সেবন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে।
যৌনপল্লীর নারী ও শিশুদের নিয়ে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন মুক্তি মহিলা সমিতির প্রোগ্রাম ডিরেক্টর আতাউর রহমান মঞ্জু বলেন, যৌনপল্লীর এই অন্ধকার পরিবেশে একটি সুস্থ্য শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা ও মেধাবিকাশ স্বপ্নহীন মাত্র। তবে আমরা যৌনপল্লীর এ শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য নিয়মিত তাদের শিক্ষা বিকাশ, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, নৈতিক শিক্ষা, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদানসহ নানা ধরনের কাজ করে আসছি। এরই মধ্যে পল্লীর অনেক শিশু-কিশোরকে হাতে-কলমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং বর্তমানে তারা স্বাভাবিক ও সুস্থ্যভাবে জীবন কাটাচ্ছে।
মুক্তি মহিলা সমিতির সভাপতি মর্জিনা বলেন, ‘এখানে এখন ডে কেয়ার ও নাইট কেয়ার মিলিয়ে ১৬২ জন শিশু আছে। তাদের বয়স তিন থেকে ছয় বছরের মধ্যে। আমরা তাদের খাওয়াদাওয়া, পড়ালেখা, খেলাধুলা সবকিছুই দেখি। যৌনপল্লি ছাড়া আশপাশের দরিদ্র পরিবারের শিশুরাও এখানে এসব সুবিধা পায়। ছয় বছর হলে এই শিশুদের স্কুলে ভর্তি করা হয়।’
শিশুদের দেখা শোনার জন্য এখানে ৪২ জন কর্মী আছেন। তাদের মধ্যে সাতজন পুরুষ, বাকিরা নারী।