রূপগঞ্জে মোবাইলে ঝুঁকছে শিশু, কমছে শারীরিক কসরত, বাড়ছে রোগ
মাহবুব আলম প্রিয়, রূপগঞ্জ
🕐 ৫:৪৮ অপরাহ্ণ, জুন ২৯, ২০২২

সভ্যতার ক্রমবিকাশ আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে গ্রামীণ খেলাধুলা। যে খেলাধূলার মাধ্যমে শারীরিক কসরত করে সুস্থ্য থাকতো সব বয়সীরা। কিন্তু মাত্র ২০ বছর পূর্বে শৈশবে যেসব খেলাধুলা করে শিশুরা কাটাতো তাদের শৈশব সেইসব যেন এখন শুধুই স্মৃতি। সময়ের ব্যবধানে হাতে হাতে মোবাইল।অভিভাবক আর সন্তান উভয়ের মাঝে প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে মোবাইল আসক্তি।
ফলে শারীরিক কসরত কমে যাওয়ায় বয়স্ক কিংবা শিশুদের মাঝে দেখা দিচ্ছে নানা রোগবালাই। এতে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের জনসাধারনের মাঝে। চিকিৎসকদের দাবী, শিশুদের মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে রাখতে না পারলে অচিরেই অসুস্থ্য আগামী প্রজন্ম তৈরী হবে। তাই সচেতন মহলকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন তারা।
সূত্র জানায়, মোবাইলের আসক্তি বিনাশ করছে শিশুদের মেধা, শারীরিক ও মানষিক শক্তি। করোনার সময় লকডাউনে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিশুদের খেলনার তালিকায় প্রথমেই দেয়া হয়েছিলো মোবাইল ফোন। আবার বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার অযুহাতে ২য় দফায় দেয়া হয়েছিলো এ ফোন। এভাবে শিশুদের বায়না পূরণে মোবাইলে গেম দেখা বা গান শোনা অভ্যাসে পরিণত হয়।
এসব বিষয়ে কথা বলেন রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পণা কর্মকর্তা ডাক্তার আইভী ফেরদৌস। তিনি বলেন, মোবাইল নামীয় এই যন্ত্রটি সিগারেটের চেয়ে হাজার গুণ বেশি ক্ষতি করছে শিশুদের। আর আমরাও না জেনে কিংবা না বুঝে আমাদের সন্তানের মেধাশক্তি ধ্বংস করছি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে।
তিনি আরো বলেন, মোবাইলের আসক্তি শিশুদের ব্রেনকে একমুখী করে ফেলছে। মোবাইলের কোনো সেটিং কিংবা কোনো ফাংশনকে শিশুরা সহজে আয়ত্তে নিতে পারলেও শিশুদের চোখের এবং ব্রেনের ক্ষতি অনেক বেশি। দৃষ্টি শক্তি ও মানষিক বিকাশেও বাঁধা এটি। তাই শিশুদের হাতে মোবাইল দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
শিশুদের আসক্তি কেবল অভিভাবকদের ব্যস্ততার কারনে হচ্ছে। এমন দাবী করে রূপগঞ্জ উপজেলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি আব্দুল রহিম বলেন, এককালে দাদী বা মায়ের মুখে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে শিশুরা খাবার খেত কিংবা ঘুমাতে যেত। আর এখন শিশুদের মোবাইল ফোনের আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে,মা বাবা তার ব্যস্ততা রক্ষা করতে গিয়ে শিশুদের হাতে নানা কারনে মোবাইল তুলে দিচ্ছেন। মোবাইলের গান শুনিয়ে, দেখিয়ে খাওয়াচ্ছেন। এভাবে শিশুরা মোবাইলের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার নাজমুল ইসলাম বলেন, মোবাইল শিশুদের মানসিক সমস্যা সৃষ্টির পাশাপাশি আশঙ্কাজনকভাবে কর্মস্পৃহা কেড়ে নিচ্ছে। শারীরিকভাবেও শিশুরা নানা সমস্যায় পড়ছে। তবে শিশুদের হাতে মোবাইল ফোনসহ কোনো ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস দেয়া উচিত নয়। এতে নানা ধরনের রোগের জন্ম হয় শিশুদের শরীরে।মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ভীষণ ক্ষতি করে।দীর্ঘ সময় মোবাইলে যুক্ত থাকলে ওজন বেড়ে যায়। আর ওজন বাড়লে নানা রোগ দেখা দেয়।
রূপগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক ও কবি আলম হোসেন বলেন, আমাদের শৈশবকালে গ্রামের শিশু ও যুবকরা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কসরতযুক্ত খেলাধুলায় অভ্যস্ত ছিল। তারা অবসরে গ্রামের খোলা মাঠে দলবেঁধে খেলতাম। তখন এতো রোগ বালাই হতো না। এখন মাঠ-বিল-ঝিল হারিয়ে যাওয়ায়, আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া হারিয়ে যেতে বসেছে এসব খেলাধুলা। শিশুরা খেলার সুযোগ না পাওয়াতে মোবাইলে ঝুঁকে গেছে। যা শিশু বিকালে চরম হুমকী।
সূত্র জানায়, শারীরিক কসরতযুক্ত দেশের জাতীয় খেলা হিসেবে পরিচিত কাবাডি খেলার আয়োজন নেই বললেই চলে। তাছাড়া দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, বৌচি, কানামাছি প্রভৃতি গ্রামীণ খেলার প্রচলনও নেই কোথাও। গ্রামবাংলার খেলাধুলার মধ্যে যেসব খেলা হারিয়ে গেছে তাদের মধ্যে হা-ডু-ডু, কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা, ডাংগুলি, গোল্লাছুট, গোশত তোলা, চিক্কা, কুতকুত, ল্যাংচা, কিং কিং খেলা, বোমবাস্টিং, হাড়িভাঙা, চাঁ খেলা, বৌচি, কাঠিছোঁয়া, দড়ি লাফানো, বরফ পানি, দড়ি টানাটানি, চেয়ার সিটিং, রুমাল চুরি, চোখবুঝাবুঝি, কানামাছি, ওপেন্টি বাইস্কোপ, নৌকাবাইচ, ঘোড়াদৌড়, এলাটিং বেলাটিং, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই অন্যতম।তবে ওপেন টু বাইস্কোপ, ষোল গুটি, লুডু , দাবা, তাস খেলা গ্রামীন হলেও তাতে শারীরিক কসরত না থাকায় এসব খেলাও পরিহার করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
তবে এখনো রূপগঞ্জের দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মাঝে বিকাল বেলায় গ্রামীণ কিছু খেলাধূলা করতে দেখা গেছে। এসবের মাঝে বাইসাইকেল বা রিক্সার চাকার বিয়ারিং দিয়ে তিন চাকার গাড়ী চালায় অনেকে। ২৮ জুন মঙ্গলবার বিকালে উপজেলার মাছুমাবাদ দীঘির পাড়ে শিশুদের এমন খেলায় যুক্তথাকা শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের মা বাবা গরীব শ্রমিক।
বাড়িতে বাটন মোবাইল তাদের। তাই বিকাল হলে গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা ছাড়াও বিয়ারিং গাড়ী চালায় তারা।তাদের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের সন্তানরা স্কুল শেষে বিকালে শারীরিক কসরত জাতীয় খেলাধূলা করে। তাই রোগ বালাই হয় না তেমন। অপরদিকে মোবাইল আসক্তিতে থাকা সচ্চল পরিবারের শিশুদের মাঝে রোগবালাইয়ের সংখ্যা বেশি বলে দাবী করেন তারা।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
