ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কর্ণফুলীতে অভিনব প্রতারণার ফাঁদ

জে জাহেদ, চট্টগ্রাম
🕐 ১২:১২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০২১

কর্ণফুলীতে অভিনব প্রতারণার ফাঁদ

অভিনব প্রতারণা আর সুকৌশলী এক প্রতারক চক্রের খবর মেলে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে। বিস্ময়কর এই প্রতারণার ফাঁদ পেতে চক্রটি সমাজের শিক্ষিত ও সচেতন শ্রেণি এবং এলাকার জনপ্রতিনিধিদের বোকা বানিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বিভিন্ন অপারেটরের একাধিক সেল নম্বর ব্যবহার করে প্রতারণার জাল বিস্তার করেছেন তারা। এদের একজন পরিচয় দিচ্ছেন কোস্টগার্ড অফিসার, অন্যজন পুলিশের এসআই। কেউ কেউ পরিচয় দিচ্ছেন সাম্পান মাঝি কিংবা মিস্ত্রি বা আসামির আশ্রয়দাতা। তবে তার কিছু তথ্য বেরিয়ে আসলেও লোকলজ্জার ভয়ে চাপা পড়ে যাচ্ছে অনেক। এক অভিযোগে জানা গেছে এসব।

অভিযোগ বলছে, সক্রিয় এ প্রতারক চক্র মোবাইলে বিকাশ, নগদের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অর্থ। এর বাইরে সমাজের নানা স্তরে এদের জালিয়াতি প্রতারণার যেন শেষ নেই। প্রতারকরা যখন বহুরূপী প্রতারণায় আগ্রাসী, তখন হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। এমন ভয়ানক প্রতারণার শিকার হয়েছেন চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের তিন ইউপি সদস্য। জানা গেছে, ৪ অক্টোবর প্রতারণার শিকার হন চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও ব্যবসায়ী ফরিদ জুয়েল। তখন রাত ২টা। ০১৩১১-১০৩৪৮৯ থেকে ফোন কল আসে। পরিচয় দেন কোস্টগার্ড অফিসার ফারুক। তিনি জানান, ইলিশ ধরা বন্ধ।

এ সময় নদীতে অভিযান চালালে ৭০০ পিস বড় ইলিশসহ কয়েকজনকে আটক করেছেন। এক আসামি এলাকায় লুকিয়ে রয়েছে। মেম্বারকে একটু সাহায্য করতে হবে। আসামিকে ০১৮৭৪৮০২২১৩ নম্বরের এক আশ্রয়দাতা লুকিয়ে রেখেছেন। তিনি আরও জানান, মাছগুলো জব্দ করে আসামিদের কর্ণফুলী থানার এসআই জাহাঙ্গীরের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বাসযোগ্য করতে পরক্ষণেই এসআই জাহাঙ্গীর সেজে এই ০১৮৩২৯৯৫০৮৪ থেকে কল করা হয় মেম্বারকে। এরপর ০১৮৯০৫০৮০০৬ থেকে কল করে এক সাম্পান মাঝি। তিনিও মেম্বারকে বাবু ডেকে সম্বোধন করে সাম্পানে ইলিশ মাছ নিয়ে আসার কথা জানান।

এদিকে, কথিত কোস্টগার্ড অফিসার আবার কিছু মাছ বিক্রি করে এতিমখানায় দেওয়ার কথাও বলেন। এভাবেই রাত গভীরে শুরু হওয়া কথোপকথন আর নাটকীয় ঘটনা শেষ পর্যন্ত পরদিন বিকেলে নগদের এই ০১৮৮৩৬০৩১০১ মেম্বার থেকে হাতিয়ে নেন ১০ হাজার টাকা। অভিযানে অংশ নেওয়া কিছু লেবার ও লোকদের খরচের কথা বলে মূলত এরা টাকাটা হাতিয়ে নেয়। এদের উপর্যুপরি কল আর একেক জনের একেক পরিচয় দেওয়ায় যে কেউ বিব্রত হবে। কেননা বিশ্বাসযাগ্য কাহিনী তৈরি করতে ছলচাতুরীর কোনো শেষ ছিল না তাদের। বোকা বানিয়ে টাকা হাতিয়ে কিছুক্ষণ পর দেখা যায় ফোন বন্ধ।

একই সিন্ডিকেটের প্রতারণার শিকার সাইদুল হক (৫০)। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী ও চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগর ৭নং ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি। গত ৫ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে ০১৩১১-১০৩৪৮৯ এবং ০১৮৪২১২৫৪০১ নম্বর থেকে কল করে জানায় ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির কিছু মাছ আছে জাহাজে। তা আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। প্রাথমিকভাবে বিকাশে কিছু পেমেন্ট করতে হবে। সাম্পানে করে মাছ আপনার অফিসে পাঠাচ্ছি। ফোনে একেক জন ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় দেন। এভাবেই সাইদুল হকের কাছ থেকে ওই দুই নম্বরে বিকাশে হাতিয়ে নেওয়া হয় ৭০ হাজার টাকা। পরে যোগাযোগ করলে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। কয়েক ঘণ্টা পর আবার খুলে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইউপি সদস্য বিষয়টি বুঝে ওঠার আগেই এসব ঘটে যায়। মাছের লেনদেন এভাবে চলে বলে প্রতারকরা আরও বেশি সুযোগ পাচ্ছে বলে জানা যায়। এ ঘটনায় পরে পুলিশের শরণাপন্ন হলেও এখনো টাকা উদ্ধার হয়নি।

প্রতারণার শিকার কর্ণফুলী উপজেলার আরেক জনপ্রতিনিধি ইছানগর গ্রামের ইউপি সদস্য আব্দুর রাজ্জাক। পেশায় তিনিও ব্যবসায়ী। বেশ কিছুদিন আগে অপরিচিত এই ০১৩১১১০৩৪৮৯ থেকে কল আসে। অপরপ্রান্ত থেকে পরিচয় দেন দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় অফিস থেকে বলছেন। এখানে প্রতারকের টোপ ছিল- করোনার সংকটময় সময় সরকার গরিব মানুষদের জন্য মাসিক টাকা ও চাল। বলা হয়, একেক কার্ডে টাকা পাবে ১২ হাজার। সঙ্গে পাবেন ১ বস্তা চাল। প্রতি মেম্বারের জন্য ১০টি কার্ড বরাদ্দ। আর এর বেশি চাইলে টাকা পাঠাতে হবে বিকাশে। এমন কথায় বিশ^াস এনে ইউপি সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বিকাশের তিনটি নম্বরে পাঠিয়ে দেন ৫৫ হাজার টাকা। পরে দেখি ফোন বন্ধ।

এভাবে একের পর কর্ণফুলীর বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের টার্গেট করে প্রতারক চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। অনেকে থানায় জিডি কিংবা অভিযোগ করছেন। আর কেউ না। কারণ ১০-২০ হাজারের জন্য আইনি ঝামেলায় যেতে নারাজ ভুক্তভোগীরা। নয়তো লোকলজ্জার ভয়ে নীরবে সহ্য করে নিচ্ছেন।

ওদিকে, শত চেষ্টা করে থামাতে পারছে না প্রতারণার অপরাধ। শনাক্ত কিংবা আটকের বাহিরে রয়ে যায় মূল প্রতারক। থানায় জিডি অভিযোগ এবং মামলা দায়েরের পরও বন্ধ হচ্ছে না প্রতারণা। উপরন্তু, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এসব অভিনব সব অপরাধ। অধিকতর বিস্তৃত হচ্ছে প্রতারকদের জাল। একের পর এক অভিযোগ আসছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন ইউনিটে। যেন অভিযোগের পাহাড় তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সামনে।

গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে প্রতারকরা বিভিন্ন জনের নামে সিম কার্ড রেজিস্ট্রেশন করে এই প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। যার কারণে এদের আটক করতে হিমশিম খেতে হয়। নম্বরগুলো আরেক জনের নামে নগদ ও বিকাশ খোলা। বহু কৌশল এদের। তবে কোনো এজেন্ট/ পারসোনাল নম্বর হতে টাকা ক্যাশ করে তুলে নিল। সেটাই শনাক্ত করা দরকার। অপরাধীদের লোকেশন আবার ভিন্ন ভিন্ন জেলায় হয়ে থাকে। এভাবেই নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ ব্যবসায়ীরা। প্রতারণার ধরনও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। তবুও টার্গেট করেই প্রতারণা চালাচ্ছে। কেননা ওই প্রতারক চক্র নিশ্চিত জানে যে, কাকে কীভাবে টোপ দিতে হবে। কারণ ওই চক্রের কোনো না কোনো সদস্য ভিকটিমদের পূর্ব পরিচিত।

সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশন ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরা বলেন, ‘মোবাইল ব্যাংকিং বিষয়ে গ্রাহকরা এখনো তেমন একটা সচেতন হননি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রতারিত গ্রাহক না বুঝিই প্রতারকের ফাঁদে পা দিয়েছেন।’ আর যারা প্রতারিত হয়েছেন তাদের বড় অংশই শিক্ষিত। আর টার্গেট করেই প্রতারণা করছে প্রতারকরা।

সিএমপি পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) শামসুল আলম বলেন, ‘প্রতারকদের সব ধরনের কৌশলের বিষয়ে প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। কেননা লোভের ফাঁদে পড়া যাবে না।’

 
Electronic Paper