ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রশান্তিদায়ক রাজাঝির দীঘি

আবদুল্লাহ আল-মামুন, ফেনী
🕐 ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২১

প্রশান্তিদায়ক রাজাঝির দীঘি

দ্রুত অগ্রসরমান জনপদ ফেনী। ক্রমবর্ধমান এ শহরের প্রাণকেন্দ্রে হাজারো মানুষের স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার এই একটি জায়গা ‘রাজাঝির বা রাজনন্দিনীর দীঘি’। পথচারীদের প্রশান্তি মিলছে এই দীঘির পাড়ে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি পরিবেশে সেখানে অভ্যর্থনা জানায় সবুজ প্রকৃতি।

দীঘির পাড়ে গাছের শীতল ছায়ায় বসে নিজেকে কিছু হলেও সতেজ করে নিচ্ছেন শহরের মানুষ। দীঘির চারপাশ জুড়ে সুদৃশ্য হাঁটার পথ। সে পথে প্রাতঃভ্রমণে বের হচ্ছেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ। পথের পাশেই লাগানো নানা প্রজাতির ফুল, পাতা বাহারের মধ্যে রয়েছে বসার আসন। সবমিলিয়ে অসাধারণ আবহ তৈরি করেছে ফেনী পৌর কর্তৃপক্ষ।

দর্শনার্থীরা জানান, পৌর কর্তৃপক্ষ দারুণ পদক্ষেপ নিয়েছে। ফেনী শহরের মানুষদের স্বস্তিতে বসার ও হাঁটার অন্যতম স্থান এই রাজাঝির দীঘির পাড়। দীর্ঘদিন ধরে এখানে হাঁটাচলার পরিবেশ ছিল না। পৌরসভার আন্তরিক প্রচেষ্টায় এখন আবার সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

ইসমাইল হোসেন নামে ফেনী সরকারি কলেজের এক শিক্ষার্থী জানান, শহরের প্রাণকেন্দ্র এই দীঘিটা। এখানে বসার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা প্রয়োজন ছিল। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে হলেও একটা শহরের এমন একটা জায়গা দরকার।

শহরের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নাগরিক নুর নবী জানান, গত ৩৫ বছর ধরে পাড়গুলো বার বার অবৈধ দখলে গেলেও পুনরায় দখলমুক্ত করায় আসল রূপে ফিরে এসেছে এ দর্শনীয় দীঘি। পাড়ের রাস্তাগুলোতে আবার ভিড় করতে শুরু করেছে শহুরে জীবনে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষগুলো। সাম্প্রতিক সময়ের দীঘির অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সৌন্দর্যবর্ধনের ফলে নজর কাড়ছে সাধারণ মানুষ ও ভ্রমণপিপাসুদের।

২০১৭ সালের জুলাই মাসে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অর্থায়নে ও ফেনী পৌরসভার তত্ত্বাবধানে কর্তৃপক্ষের নেওয়া উদ্যোগে পাল্টে গেছে দীঘির চেহারা। পর্যটকদের যাতায়াত বেড়েছে কয়েকগুণ।

ফেনী পৌরসভার উপ-প্রকৌশল বিভাগ জানায়, ৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজাঝির দীঘিরপাড়ের দৃষ্টিনন্দন বিনোদন কেন্দ্রের নির্মাণ আংশিক সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ ফেনী পৌরসভার নিজস্ব উদ্যোগে সম্পন্ন করেছে। পৌরসভার পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে আরও নানা উদ্যোগ।

ফেনী পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী বলেন, ঐতিহাসিক রাজাঝির চারপাশ দখলমুক্ত করা হয়েছে। এ দীঘির পাড়ের নির্মল বাতাস পেতে দীঘির পাড়কে নান্দনিক রূপ দেওয়া হয়েছে। দীঘির এক কোনায় একটি দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা স্থাপন করা হয়েছে। বসার জন্য সুব্যবস্থা করা হয়েছে। লাগানো হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ও পাতা বাহারের গাছ। রাতের বেলায় দীঘির পাড়কে নিরাপদ রাখার জন্য করা হয়েছে বাতির ব্যবস্থা। ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে পাত্র রাখা আছে। মানুষ যদি নিজেরা সচেতন হয় তাহলে এখানে সৌন্দর্য আরও বাড়বে। বার বার অভিযান চালিয়ে দীঘির চারপাশ অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়েছে। প্রাকৃতিক শোভা মানুষ এখন উপভোগ করতে পারবে।

রাজাঝির দীঘির পাড় মানুষের চলাচলের জন্য উপযোগী ও সৌন্দর্যবর্ধনে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফেনী জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান।

তিনি বলেন, রাজাঝির দীঘির পাড়কে আরও দৃষ্টিনন্দন করতে জেলা পরিষদের শিশুপার্কেও দেয়াল সরিয়ে ফেলা হবে। এছাড়াও দীঘির চারপাশের রাস্তাটিকে মানুষের চলাচলের উপযোগী করে তোলা হবে। এজন্য জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট থেকে ফান্ডের ব্যবস্থা করার জন্য চেষ্টা চলছে। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান চলবে। দীঘির পাড় যাতে দখল না হয়ে যায় সেজন্য অভিযান চলবে। হকারদের কোনো স্থাপনা নিয়ে বসতে দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে প্রশাসন সতর্ক থাকবে। এছাড়া পুরো পাড় সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হবে।

শহরের গোড়াপত্তন : এক সময় এ দীঘির পাড়েই গোড়াপত্তন হয়েছিল মহকুমা শহরের। ফেনী জেলা প্রতিষ্ঠারও আগে ফেনীর মহকুমা প্রশাসক কবি নবীন চন্দ্র সেন রাজাঝির দীঘির পাড়ে বসে কবিতা লিখতেন। তিনি মহকুমা প্রশাসক হিসেবে আসার পর দীঘির পাড় বাঁধাইসহ চারপাশে ব্যাপক সংস্কার করেন। গুরুত্বপূর্ণ চারটি সড়কবেষ্টিত দীঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল শহরের কাঠামো। মহমকুমার দাপ্তরিক কাজ, আদালত সবই ছিল দীঘির চার পাশে। দেড়শ’ বছর আগেই এ দীঘির চারপাশে চলাচল করতেন স্থানীয়রা। এখনও দীঘির পাড়ে রয়েছে ফেনী সদর থানা, কোর্ট মসজিদ, অফিসার্স ক্লাব এবং জেলা পরিষদ পরিচালিত শিশুপার্ক, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনসহ আরও নানা স্থাপনা। এ দীঘিটি যেন এ শহরের নাভী।

ফেনী শহরের নাভী : ফেনী শহরের নাভী বলা হয় এই দীঘিকে। এ শহরের রূপ লাবণ্য অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে সুবিশাল এই দীঘি। একটি চক্র গত ৩৫ বছর ধরে ১০ দশমিক ৩২ একর আয়তনবিশিষ্ট এ ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানকে দখল করে রাখে। সাম্প্রতিক সময়ে এ দীঘির চার পাশকে দখলমুক্ত করে ফেনীর জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় জেলা প্রশাসন। ফেনী জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ ও ফেনী পৌরসভার যৌথ উদ্যোগে দীঘিটি এখন যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। প্রতিদিন দর্শনার্থীসহ অনেক মানুষের সমাগম ঘটছে রূপবতী এই দীঘির পাড়ে। ফেনীর সাধারণ মানুষ চায় এর রূপ লাবণ্য অটুট থাকুক। কোনো অবৈধ দখলদারিত্বের কবলে যেন না যায় দীঘিটি।

গোড়ার কথা : ইতিহাস বলছে ত্রিপুরা মহারাজ্যের প্রভাবশালী একজন রাজা তার কন্যার অন্ধত্ব দূর করার বাসনায় প্রায় ৭০০ বছর আগে এ দীঘি খনন করেছিলেন। ফেনীর ঐতিহাসিক রাজাঝির বা রাজনন্দিনীর দীঘি প্রসঙ্গে কবি নবীনচন্দ্র সেন আত্মজীবনীতে এই দীঘির বর্ণনা লিখেছেন। ঊনবিংশ শতকের আশির দশকে ফেনী মহকুমার প্রশাসক এ দীঘির রূপ লাবণ্য ফুটিয়ে তুলতে তিন দফায় ৪ হাজার ৮০০ টাকা বরাদ্দ করেন। সে সময়ে দীঘির চারপাশ ঘিরে ফেনী শহরের প্রশাসনিক কাঠামো গড়েছিলেন তিনি।

 
Electronic Paper