বিপদজনক পটকা-বাজি হাতে খেলা করছে গ্রামের শিশু-কিশোররা
হাকিম মোল্লা, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
🕐 ৯:১২ পূর্বাহ্ণ, মে ১৪, ২০২১
বিপদজনক পটকা-বাজি হাতে খেলা করছে গ্রামের শিশু-কিশোররা। ভয়াবহ শব্দ দূষণ ছাড়াও এ পটকার বারুদে যেকোনো সময় ঘটতে পারে ভয়ংকর দুর্ঘটনা। শিশুদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে অপরাধপ্রবণতা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘাড়ের উপর দিয়েই শিশুদের হাতে এসব অবৈধ সামগ্রী তুলে দিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।
সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েকটি বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, শিশুদের হাতে এসব অগ্নিসহায়ক খেলনার আধিপত্য।
পটকা-বাজির সলতেতে আগুন দেয়ার জন্যে সবসময়ই শিশুরা সঙ্গে রাখছে দিয়াশলাই বা গ্যাস লাইটার। ঝুঁকি নিয়ে পটকার সঙ্গে ছোট সলতেতে আগুন লাগিয়েই দৌড় দিয়ে সরে যাচ্ছে তারা।সময়ের হের-ফের হলেই ঘটতে পারে বিপদ।
দেশে এক সময় শব-ই-বরাতে এবং গ্রামাঞ্চলে ঈদুল ফিতরের সময়টুকুতে প্রচুর পটকা-বাজি ফোটানো হতো। তবে বিভিন্ন দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০০৪ সাল থেকে সকল ধরনের পটকা-বাজি নিষিদ্ধ করে সরকার। দশ বছর পর আবারো শিশুদের বিনোদনের সামগ্রী হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিপদজনক পটকা-বাজি।
ঈদের আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতে ভাটিয়ারী পূর্ব হাসনাবাদ বালুর রাস্তা থেকে শুরু করে বৌবাজার এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, একাধিক মুদি দোকানে বিক্রি হচ্ছে পটকা-বাজি।
দোকানের ভেতরে নির্বিঘ্নে পটকা-বাজি বিক্রি হচ্ছে। আর শিশুদের ভিড়তো লেগেই আছে। অবৈধ হওয়াতে এসব পটকা-বাজি রাখা হয়েছে দোকানের ওপরের সিলিংয়ে আবার অনেকে দাপট দেখিয়ে দোকানের সামনেই সাজিয়ে রেখেছেন।
দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, পেপারে মুড়িয়ে শিশুদের মাঝে বিক্রি করা হচ্ছে এসব পটকা। সন্ধ্যা ৭টার দিকে কমপক্ষে ২০ জন শিশুকে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের পটকা কিনতে। অর্ডার দিলেই নিষিদ্ধ মাদকের মতো করে কাগজের ভাজে লুকিয়ে শিশুদের হাতে দেওয়া হচ্ছে। বিক্রির ভিড় সামলাতে দোকানের মালিক তার ছোট্ট শিশুকেও এ কাজেই নিয়োজিত রেখেছে।
ক্রেতা সেজে দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৬ ধরনের পটকা আর বাজি বিক্রি হচ্ছে এই পাইকারি দোকানে। এখানে একবারে প্যাকেট কিনতে হয় এবং খরচ কিছুটা কম। দেখা যায়, তারাবাতি নামক বিজলীবাতির চাহিদা রয়েছে বেশ।
তামার তারের ওপর বারুদ মেখে কলমের মতো করে বানানো হয় এই বাজি। এই বাজিতে আওয়াজ হয় না। বারুদ মাখানো অংশটুকু বিজলী বাতির মতো জ্বলতে থাকে। শিশুরা তামার খালি অংশ হাতে নিয়ে ঘুরায়। তবে বারুদের অংশের সঙ্গে তামাও পুড়ে যায় অনেক সময়, তখনই শিশুদের হাত পোড়া যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এছাড়াও আগুনের ফুলকিতে শিশুর গায়ের কাপড় এবং বাসার বিভিন্ন স্থানে আগুন লেগে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। বিজলীবাতির ফুলকিতে চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে প্রবল।
হাতে নিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্টিজে তৈরি হওয়া এই তারাবাতি বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কোন অনুমোদন নেই। এছাড়াও এ তারাবাতি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানটিকে বিএসসিআইসি কর্তৃক অনুমোদিত নেই প্যাকেটের গায়ে। ব্র্যান্ডের এই তারাবাতির এক প্যাকেটের মূল্য ৩৫ টাকা।
একেএস’ নামে প্যাকেট পটকা বিক্রি করা হচ্ছে শিশুদের কাছে। হাতে নিয়ে দেখা যায়, প্লাষ্টিক প্যাকেটে ২৮টি পটকা মোড়ানো রয়েছে, যেগুলো দেখতে ছোট পেন্সিল ব্যাটারির মতো। প্রতি পিচ ২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চকলেটের দামে কিনতে পারায় শিশুরা বাবা মায়ের অজান্তে চকলেটের পরিবর্তে এই পটকা কিনে ফুটাচ্ছে।
ভাটিয়ারী পূর্ব হাসনাবাদ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, শিশুদের হাতে এই পটকা। উঠোনে বিকট আওয়াজ তৈরি করছে এ পটকাগুলো। শব্দ দূষণ ছাড়াও বৃদ্ধ এবং অসুস্থদের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর এ পটকার আওয়াজ।
এই গ্রামের ভোলাইয়া পাড়ার রাজ মিস্ত্রি সবুজের ছোট্ট এক শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খোলা দোকানে ককটেল নামের এ পটকা প্রতি পিস ২ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। আশপাশের দোকানগুলোতেই এসব পটকা খুচরা বিক্রি হচ্ছে।
এলাকার সোলেমানে তার শিশু পুত্রকে দিয়ে বিক্রি করছেন কিট-ক্যাট পটকা। এ পটকার আওয়াজ আরো বেশি বিকট। যত বেশি আওয়াজ তত বেশি দাম। গুলের কৌটার মতো এক একটি পটকা বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা করে।
স্থানীয় আলমের দোকানে গিয়ে দেখা যায় সেখানেও দোকানদার পরিবারের ছোট শিশুটিকে এই পটকা বিক্রির কাজে লাগিয়েছেন। শিশুটি জানায়, কিট-ক্যাটের চেয়েও বিকট আওয়াজ তুলতে সক্ষম ‘চকলেট’ নামের পটকা। এটিও দেখতে গুলের কৌটার মতো। প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে
২০ টাকা করে। এর চেয়েও বেশি আওয়াজের জন্যে রয়েছে ককটেল। যার মূল্য ১০০ টাকা।এটা কিন্তু হরতালে পিকেটারদের ছোড়া ককটেলের মতোই আওয়াজ হয়। আর বিপদও সে মাত্রার হতে পারে।
চকলেট এবং কিট-ক্যাটের মতো পটকার বিকট আওয়াজে আশপাশের মানুষের কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: নুর উদ্দিন রাশেদ।
তিনি বলেন, শ্রাব্যতার পাল্লা অতিক্রম করলে বিকট আওয়াজে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও দীর্ঘদিনের জন্যে কানের শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পায়। আচমকা আঘাতে স্নায়ু দূর্বল হয়ে বড় ধরনের অসুখের সম্ভাবনাও থাকে।
সরেজমিনে দেখা গেছে বাজি কাগজের বড় প্যাকেটে মুড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। শিশুরা জামার নিচে লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এসব বাজি।
১১ বছরের এক শিশু সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু আগুনের ফুলকির ওপর ভিত্তি করে বেশ কয়েক ধরনের বাজি রয়েছে। বোম সাদৃশ্য পটকা রয়েছে। যেটা ঘরবাড়ির জন্যে বিপদজনক। এটি থেকে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে।
‘কিট-ক্যাট’ বা ‘চকলেট’ সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে এলাকাটিতে। শিশুদের কাছে এগুলো বোমা নামেই বেশি পরিচিত। শিশুদের খেলনা বিক্রির যে কোন মনোহরদী দোকানেই পাওয়া যাচ্ছে এ বাজি।
শুধু ভাটিয়ারীতে নয়, উপজেলার কমবেশি সকল ইউনিয়নে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হচ্ছে এসব পটকা-বাজি। আর বাড়ির সামনের মুদি দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে খুচরা পটকা।
গ্রামের দরিদ্র শ্রেনির মানুষের শিশুদের টার্গেট করে বিক্রি হচ্ছে এসব ভয়ানক পণ্য। এসব পটকা শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি শিশুদের মানসিক বিকাশকেও করছে বাধাগ্রস্থ।
ভাটিয়ারী হাজি টি এ সি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আশ্চার্য বলেন, গ্রামে কিছুটা মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠে শিশুরা, যেখানে অভিভাবকদের হাতে।