ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শান্তির জনপদ বেগমগঞ্জ অপরাধের স্বর্গরাজ্য

ইকবাল হোসেন সুমন, নোয়াখালী
🕐 ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১২, ২০২০

উপকূলীয় অঞ্চল নোয়াখালীকে বলা হতো শান্তির নগরী। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে কিছু বিতর্কিত কর্মকা-ের সেই ঐতিহ্য হারাতে বসেছে নোয়াখালী। বিশেষ করে গত জাতীয় নির্বাচনের দিন রাতে জেলার সূবর্ণচরে ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে গৃহবধূকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে স্থানীয় সরকার দলীয় নেতা। সেই ঘটনায় সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। আবারও ধর্ষণকাণ্ড দিয়ে আলোচনায় নোয়াখালী। জেলার বেগমগঞ্জের একলাশপুরে গৃহবধূকে সরকারদলীয় নেতাকর্মী কর্তৃক বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ সারাদেশ।

জানা গেছে, নোয়াখালীর বাণিজ্যিক শহর চৌমুহনীসহ বেগমগঞ্জ উপজেলায় রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বেশকিছু সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি রয়েছে। এদের দৌরাত্ম্য এতই ব্যাপক যে এলাকাবাসীকে সবসময় তাদের ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের গ্রেফতার করলেও আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যায় তারা।

বেগমগঞ্জের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। এ সুযোগে উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নে ও চৌমুহনী পৌরসভার বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় অর্ধশতাধিক বাহিনী গড়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে এসব বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো উপজেলায়। ফলে এক সময়ের শান্তির জনপদ এখন অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে একলাশপুরে বিবস্ত্র করে নারী নির্যাতন ও ভিডিও প্রচার করার ঘটনার মতো জঘন্য-ঘৃণিত অপরাধের মধ্য দিয়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী জানান, একলাশপুরের এ জঘন্য ঘটনার মধ্যদিয়ে বেগমগঞ্জে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী ও জেলা উপজেলার বেশ কয়েকজন নেতার মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। এখানে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না থাকলেও আওয়ামী লীগের কোন্দলের সুযোগ নিচ্ছে অনুপ্রবেশকারী একটি সুযোগসন্ধানী চক্র।

সম্প্রতি বেশ কয়েকবার আওয়ামী লীগের একাধিক গ্রুপে প্রকাশ্যে তারা সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বিশেষ করে গত সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই দলীয় কোন্দল মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যার কারণে বেগমগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতারা যে যার মতো করে বর্তমানে ক্যাডার নির্ভর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এ সুযোগে উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নে ও চৌমুহনী পৌরসভার বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় অর্ধশতাধিক বাহিনী গড়ে উঠেছে। এদের অধিকাংশই বিভিন্ন দল থেকে আসা ক্যাডার বাহিনী।

এখলাশপুরে এই বর্বর ঘটনার ৩২ দিন পরও এখানকার সাধারণ মানুষের মুখ না খোলার পেছনের কারণ দেলোয়ার বাহিনীর সন্ত্রাস ছাড়াও পুলিশের সঙ্গে সখ্যতার কারণও রয়েছে। বেগমগঞ্জের বেশির ভাগ ইউনিয়নে রয়েছে এ ধরনের পৃথক সন্ত্রাসী বাহিনী। এসব বাহিনী সক্রিয় মূলত উপজেলা আওয়ামী লীগ, পৌর আওয়ামী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপের ছত্রচ্ছায়ায়। দলটির অভ্যন্তরীণ বিবাদের কারণে সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
বেগমগঞ্জের পূর্বাঞ্চলে চৌমুহনী পৌর এলাকাসহ কাদিরপুর, রসুলপুর, শরীফপুর, হাজীপুর ও এখলাশপুরে প্রধান দুটি সন্ত্রাসী বাহিনী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৩৬ মামলার আসামি সুমন ওরফে খালাসি সুমন। আরেক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৩৮ মামলার আসামি সম্রাট বাহিনীর প্রধান সম্রাট। এ দুই সন্ত্রাসী বাহিনী স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকায় বেশি বেপরোয়া। অনেক ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এদের কাছে অসহায়।

সুমন বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় দেলোয়ার নিজেও একটি বাহিনী গড়ে তুলে এখলাশপুরসহ আশপাশের এলাকায় সন্ত্রাস, মাদক কারবার, চাঁদাবাজি চালিয়ে আসছিল। কাদিরপুর ইউনিয়নে সুজন বাহিনী নামে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী সৃষ্টি করে। এই বাহিনীর প্রধান সুজন অস্ত্রসহ গ্রেফতারের পর বর্তমানে জামিনে আছেন। কাদিরপুর লন্ডন মার্কেট এলাকায় রয়েছে শাকিল বাহিনী। কুতুবপুর, রসুলপুর, দুর্গাপুর ও সেতুভাঙ্গা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন সন্ত্রাসী সম্রাটের ভাগ্নে রায়হান। এরা একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছেন। সন্ত্রাসী সুমন ও সম্রাট বর্তমানে র‌্যাবের নজরদারিতে থাকায় এলাকা ছাড়া। কিন্তু সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের বাহিনীর সদস্যরা। এখলাশপুর ইউনিয়নের পাশাপাশি শরিফপুর ইউনিয়নে এসব বাহিনীর সন্ত্রাসীরা মাদক কারবার চালাচ্ছে।

আবার দেলোয়ার বাহিনীর প্রতিপক্ষ বাহিনীও রয়েছে। কাটা রাসেল বাহিনী নামে এই সন্ত্রাসী বাহিনীও এখলাশপুর ও গাবুয়া এলাকায় সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি চালাচ্ছে। গত বছর মাদক কারবারের আধিপত্য নিয়ে পূর্ব এখলাশপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী ও আব্দুর রহিম রবিন নামের দুই যুবককে প্রকাশ্যে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে এ বাহিনী। একই বছরের ২৫ অক্টোবর এখলাশপুরের ভিআইপি সড়ক এলাকায় শাহাদাত হোসেন পলাশ নামের এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে এ বাহিনীর সন্ত্রাসীরা।

এখলাশপুরের এলাকাবাসী জানায়, এসব অপরাধ কর্মকারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বেশির ভাগ ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার। ফলে ভয়ে তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এসব অপরাধ কর্মকা- অবহিত করে না। আর করলেও লাভ হয় না বলে অভিযোগ তাদের।

পূর্ব এখলাশপুর গ্রামের সমাজ কর্মী আবুল বাশার জানায়, এসব সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে কিছু কিছু মামলা হলেও পুলিশ আসামিদের গ্রেফতার করে না। আবার কেউ গ্রেফতার হলেও কয়েক ঘণ্টার বা কয়েক দিন পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবার শুরু করে সন্ত্রাসী কর্মকার। বেগমগঞ্জে গত দুই বছরে এসব বাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকা-ে খুন হয়েছেন ১৭ জন। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা অর্ধশতাধিক। সব কয়টি খুনের মামলা রেকর্ড করলে ধর্ষণের সব মামলা রেকর্ড করেনি বেগমগঞ্জ পুলিশ।

আমান উল্যাপুরে রয়েছে মান্নান বাহিনী, মুন্সি বাহিনী, বাবু বাহিনী নামের তিনটি সন্ত্রাসী বাহিনী। গত ৩ মার্চ আমান উল্যাপুরে খুন হয় ছাত্রলীগ নেতা রাকিব হোসেন। এ ছাড়া গোপালপুর ইউনিয়নে রয়েছে জিকু কামাল বাহিনী, মাসুম বাহিনী, পিচ্চি রাসেল বাহিনী, মুজিদ বাহিনী, পাটোয়ারী বাহিনী। জিরতলী ইউনিয়নে রয়েছে মঞ্জু বাহিনী, রাজগঞ্জ ইউনিয়নে রয়েছে সেন্টু বাহিনী, ছয়ানী ইউনিয়নে রয়েছে বাবু বাহিনী। সন্ত্রাসের আরেক জনপদ আলাইয়ারপুর। একই ইউনিয়নে রয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ী ও অস্ত্রবাজ। মনা বাহিনী, ফেনাঘাটার নিজাম বাহিনী, বাবু বাহিনী ও টিটু বাহিনী। নিজাম বাহিনী প্রধান নিজাম হত্যা মামলাসহ কয়েক মামলার আসামি হলে অস্ত্রসহ গ্রেফতারের ৯ মাস পর কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও সন্ত্রাসী কর্মকা- শুরু করেছে।

বেগমগঞ্জ থানার ওসি হারুন অর রশিদ চৌধুরী জানান, সম্রাট ও সুমন বাহিনী ছাড়া এলাকায় অন্য কোনো বাহিনীর অস্তিত্ব আছে কি-না তার জানা নেই। এ দুই বাহিনীর নেতারা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এলাকায় মাদক কারবার, খুনসহ সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে।
এ বিষয়ে নোয়াখালী জেলা পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, সন্ত্রাসীদের শিকড় উপড়ে ফেলতে পুলিশ কাজ করছে। জেলার কোথাও কোনো সন্ত্রাসী বাহিনীর অস্তিত্ব রাখা হবে না।

চৌমুহনী পৌরসভার মেয়র ও চৌমুহনী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আকতার হোসেন ফয়সাল বলেন, বেগমগঞ্জ তথা নোয়াখালীতে যে কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটে গেল, তার তীব্র নিন্দা জানাই। তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে ধর্ষণ, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরীক হয়ে সন্ত্রাস নির্মূল করার আহ্বান জানান।

বেগমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. এ বি এম জাফর উল্যা বলেন, আমরা রাজনীতিবিদরা এর জন্য দায়ী। বেগমগঞ্জের রাজনীতিবিদরা নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত এবং আধিপত্য বিস্তারে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করছেন। রাজনৈতিক নেতারা কঠোর হলে সন্ত্রাসীদের শিকড় এত গভীরে যেত না।

 
Electronic Paper