উত্তপ্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প
আট দিনে ৮ খুন, সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এনজিও কর্মী, সতর্কাবস্থায় সেনাবাহিনী ও র্যাব
মো. নেজাম উদ্দিন ও কায়সার হামিদ মানিক
🕐 ৯:৪০ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ০৯, ২০২০
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, ইয়াবা ও ক্যাম্পভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দফায় দফায় চলছে সংঘর্ষ। রোহিঙ্গাদের উগ্রতায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের। গত আট দিনে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে চলমান সংঘর্ষে রোহিঙ্গা নারীসহ প্রাণ হারিয়েছে ৮ জন। এর মধ্যে একজনকে জবাই করে হত্যা করা হয়।
গোলাগুলির ঘটনায় আহত হয়েছে শিশুসহ শতাধিক, ঘটেছে দুইশর বেশি ঝুপড়ি ঘর ও ৬৫ দোকান ভাঙচুরের ঘটনা। গত মঙ্গলবারের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সেখানে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য, নিরাপত্তার খাতিরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এনজিও কর্মীদের। তবে ক্যাম্পগুলোতে এখনো রয়েছে নিষিদ্ধ বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) তৎপরতা। সারা দেশে নিষিদ্ধ আল মারকাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে ঘর দেওয়ার নামে নানা অপচেষ্টার অভিযোগ।
জানা গেছে, সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনায় চারজনের মৃত্যুর পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে উত্তেজনা বাড়ছে। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়া অপর এক রোহিঙ্গা কিশোর শফিউল আলম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বুধবার মারা গেছে।
এর আগে, উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে গত মঙ্গলবার রাতে সন্ত্রাসীদের দুপক্ষের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে মুন্নাগ্রুপ প্রধানের ভাই মোহাম্মদউল্লাহ ওরফে গিয়াস উদ্দিন, মো. ফারুক, নুরুল বোশার এবং নুরুল হুদা নিহত এবং অন্তত ২০জন আহত হয়। গত ১ অক্টোবর গোলাগুলিতে সমিরা আক্তার নামের এক রোহিঙ্গা নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এর তিন দিনের মাথায় গত রোববার ইমাম শরীফ ও শামসুল আলম নামে দুই রোহিঙ্গা নিহত হন। আর সোমবার রাতে মোহাম্মদ ইয়াছিনের নিহতের ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, বেপরোয়া হয়ে ওঠা রোহিঙ্গারা চুরি, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। শিবির থেকে বেরিয়ে স্থানীয়দের ওপর চড়াও হচ্ছে। আর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক রোহিঙ্গা জানান, ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা নেতা মৌলভী আবু আনাস ও মো. রফিকের নেত্বত্বে মুন্না গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় গুলিবর্ষণ ও হামলার ঘটনা ঘটছে। কিছুদিন আগে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা একটি সিএনজি অটোরিকশাসহ ড্রাইভারকে দিনে-দুপুরে অপহরণ করে ৪ লাখ টাকা দাবি করে।
সরকারি নিষেধাজ্ঞার পরও বহাল তবিয়তেই আগের মতো কাজ পরিচালনা করছে কয়েকটি এনজিও। তবে এপিবিএন কক্সবাজার জোনের অধিনায়ক হেমায়েতুল ইসলাম জানিয়েছেন, গত ১ অক্টোবর উখিয়ার ১৫ নং রোহিঙ্গা শিবিরের জামতলী এলাকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত এনজিও আল মারকাজুল ইসলামী নির্মিত ১৮টি বসতি উচ্ছেদ করেছে প্রশাসন। এনজিও কর্মকাণ্ডের ওপর কড়া নজরদারি করা হচ্ছে বলে অপর এক সূত্র জানায়।
কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ জালাল আহমদ জানান, আরসা গ্রুপ ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা কুতুপালং ক্যাম্প ছেড়ে অন্য ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পে থমথমে অবস্থা বিরাজ করায় রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টহল জোরদার বাড়িয়েছে।
কুতুপালং ২ নম্বর ক্যাম্পের হেড মাঝি সিরাজুল মোস্তফা বলেন, দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ছুরি ও লাঠির আঘাতে কমপক্ষে শতাধিক আহত হয়েছে জানান।
উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দায়িত্বরত ১৪নং এপিবিএনের ইন্সপেক্টর ইয়াছিন ফারুক বলেন, ‘নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপের সঙ্গে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে।’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ্দৌজা জানান, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।
উখিয়া থানার ওসি আহাম্মদ সঞ্জুর মোরশেদ জানান, দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনায় এই পর্যন্ত ৮ জনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সংঘর্ষের খবরে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
উল্লেখ্য, মিয়ানারের সরকারি বাহিনীর নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে প্রায় ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ মানবতা দেখিয়ে তাদের শরণার্থীদের আশ্রয় দিলেও রোহিঙ্গারা নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি করার চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে পাঠাতে চাইলেও নিজেদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে নানা টাল-বাহানা করছে প্রতিবেশী দেশটি।