ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পাহাড়ে অবৈধ বসতি

বর্ষা আসলেই টেনশন, উচ্ছেদের যুদ্ধ বিগ্রহ

জামালুদ্দিন হাওলাদার, চট্টগ্রাম
🕐 ৫:২০ অপরাহ্ণ, জুন ২২, ২০২২

বর্ষা আসলেই টেনশন, উচ্ছেদের যুদ্ধ বিগ্রহ

পাহাড়ে অবৈধ দখল ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদে আবারও নিজেদের অসহায়ত্ত্ব প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন। তিনি বলেন, নগরের পাহাড় থেকে অবৈধ বসতি স্থাপনে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগই মূলত দায়ী। সেবা সংস্থাগুলোর বিদ্যমান সংযোগ অপসারণ এবং ভবিষ্যতে অবৈধ বসতিতে কোনো সংযোগ না দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা লাগবে। আর ওই সিদ্ধান্ত পেলেই কেবল স্থায়ীভাবে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ও অবৈধ দখল উচ্ছেদে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া যাবে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে রেলের জমিতে ৩ হাজার বসতি স্থাপনকারী আছে। আর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের মালিকানাধীন পাহাড়ে ১৩৫টি অবৈধ স্থাপনা আছে। ওয়াসা দায়িত্বশীল কর্তারা বলছেন তাদের পাঁচটি পাহাড়ে কোনো অবৈধ স্থাপনা নেই। একইভাবে বন বিভাগেরও দাবী নগরীতে তাদের কোনো পাহাড়ে অবৈধ বসতি নেই। তবে উপজেলায় বন বিভাগের পাহাড়ে অবৈধ বসতির তালিকা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তা এখনও প্রস্তুত হয়নি।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, ‘নগরে ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় চিহ্নিত করা হয়েছে। যেসব পাহাড় ধসে পড়েছে সেখানকার বাসিন্দাদের আগেই সরানো হয়েছিল। তারা আবার চলে আসেন। গত ক’দিন আগে ফের পাহাড় ধসের পর অভিযানে ২০৫টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। যারা এসব পাহাড়ের মালিক সেই সংস্থাগুলো যেন খালি হওয়া জমি নিজেদের দখলে রাখেন। যাতে নতুন করে কেউ বসতে না পারে।’

তথ্য অনুস্থানে জানা যায়, ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামের সেনানিবাস এলাকা, লেডিস ক্লাব, কুসুমবাগ, কাছিয়াঘোনা, ওয়ার্কশপঘোনা, মতিঝরনা ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাহাড়ধসে নারী-শিশুসহ ১২৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটির ৩৬ সুপারিশ ১৫ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। এবার পাহাড়ের অবৈধ বসতিতে কীভাবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ দেওয়া হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গ ও সচেতন নাগরিক সমাজ।

এদিকে, প্রতি বছরই ঘটছে পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাহাড়ধস এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আরও ১২০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ ১৫ বছরে পাহাড়ধস এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চট্টগ্রামে ২৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় সূত্র জানায়, পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা রোধে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের প্রাণহানির পর বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে এ কমিটি গঠন করা হয়। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে আহ্বায়ক এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) সদস্য সচিব করে গঠন করা হয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। এ পর্যন্ত ২৭টি সভা করেছে কমিটি।

প্রতিটি সভায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যারা বসবাস করেন তাদের উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া বসবাসকারীদের বাসায় অবৈধ ইউটিলিটি সার্ভিস অর্থাৎ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়। কমিটির সর্বশেষ সভা হয়েছে গত ২৭ মার্চ। কমিটি ২৮টি কারণ চিহ্নিত করে ৩৬টি সুপারিশ প্রণয়ন করলেও একটিরও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এখনও বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে কয়েক হাজার পরিবার। বাড়ছে পাহাড়ধসে মৃত্যু ঝুঁকি। ৩৬ সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো শুধু নিজেদের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান করে সময় পার করছে। তাদের কর্মতৎপরতাও সীমাবদ্ধ থেকেছে লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতায়।

ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশের মধ্যে ছিল পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরতদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখা, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করতে পাহাড়ে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত থাকা, নীতিমালা প্রণয়ন, পাহাড়ে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া এবং সামাজিক বনায়নের আওতায় আনা, বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ করা, পাহাড়ের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা তৈরির অনুমোদন না দেওয়া, পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প না করা, উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের জন্য আধুনিক ও উন্নতমানের সরঞ্জামাদি ক্রয় করা।

এছাড়া পাহাড়ধস এড়াতে এবং পাহাড় ব্যবস্থাপনার সভায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পাহাড় দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও সরকারি মালিকানাধীন ঝুঁকিপূর্ণ যেসব পাহাড়ে অবৈধ বসতি সেগুলো উচ্ছেদ করা। তদন্ত কমিটির এসব সিদ্ধান্ত এখনও কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। সরকারি পাহাড়গুলোর মধ্যে কিছু রেলওয়ে, গণপূর্ত বিভাগ, ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের আওতায় রয়েছে।

জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনার পর ২৮টি কারণ উল্লেখ করেছিল তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, ভারী বর্ষণ, পাহাড়ের বালুর আধিক্য, পাহাড়ের উপরিভাগে গাছ না থাকা, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে তোলা, পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রাখা, বনায়নের পদক্ষেপের অভাব, বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালু ও মাটি অপসারণে দুর্বলতা।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি সূত্র জানায়, কমিটি জরিপ চালিয়ে ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় চিহ্নিত করেছে। ঝুঁকিপূর্র্ণ ৩০ পাহাড়ের মধ্যে আছে, সিআরবি পাহাড়, টাইগারপাস-লালখান বাজার রোড সংলগ্ন পাহাড়, টাইগারপাস মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ, মোজাফফর নগর, কাট্টলি থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত পাহাড়, সলিমপুর বাস্তুহারা পাহাড়, প্রবর্তক পাহাড়, গোল পাহাড়, ইস্পাহানি পাহাড়, বন গবেষণাগার ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়, জয় পাহাড়, চট্টেশ্বরী পাহাড়, মতিঝরনা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুল পাহাড়, আকবর শাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, ফয়েজলেক আবাসিক এলাকা পাহাড়, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি পাহাড়, ডিসি হিলের একাংশ, পরিবেশ অধিদফতর সংলগ্ন সিটি করপোরেশনের পাহাড়, এ কে খান অ্যান্ড কোং পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাধীন পাহাড়, কৈবল্যধামস্থ বিশ্ব কলোনি পাহাড়, চট্টেশ্বরী রোডের জেএফ পাহাড়, জামেয়াতুল উলুম ইসলামি মাদ্রাসা পাহাড়, ফরেস্ট রিসার্চ একাডেমি সংলগ্ন মীর হাসানের পাহাড়, ইস্পাহানি পাহাড়ের দক্ষিণ পাশের হারুন খানের পাহাড়, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, লেক সিটি আবাসিক এলাকার পাহাড় এবং নগরীর জিইসি মোড়ের ব্লোসোম গার্ডেন পাহাড়।

বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান বলেন, ‘২০০৭ সালে পাহাড়ধসের পর পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির ৩৬ সুপারিশ আজও বাস্তবায়ন হয়নি। পাহাড়ধসে মৃত্যু হলেই কেবল এ কমিটির তৎপরতা বাড়ে।’

তিনি বলেন, ‘সরকারি পাহাড়ে অবৈধভাবে গড়া বসতিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কতিপয় ব্যক্তি। কারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে হবে। পাহাড়ের বালু দোআঁশ মাটির। ফলে বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসের ঝুঁকি বাড়ে। ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা বসতি উচ্ছেদ না করায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ধসরোধে পাহাড়ে গভীর শিকড়ের গাছ রোপণের দাবি জানাই।’

চট্টগ্রামের পরিবেশবিদ ইদ্রিস আলী বলেন, ‘চট্টগ্রামের রাজনীতি, প্রশাসন এবং ব্যবসায়ী এক হয়ে গেছে। এ কারণে পাহাড় দখল ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন বাড়ছে। পাহাড়ে কীভাবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ দেওয়া হয়? এর পেছনে কারা? তাদের কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না? কেন প্রশাসন এসব বিষয়ে চোর-পুলিশ খেলা খেলছে, তাও বুঝতে পারছি না। প্রশাসন কঠোর হলেই পাহাড় রক্ষা করা সম্ভব। সেইসঙ্গে সম্ভব হবে মৃত্যুর ঝুঁকি এড়ানো।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রামে প্রতি বছর জলাবদ্ধতা ও পাহাড়ধসে মানুষের মৃত্যু যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। পাহাড়ে যারা বসবাস করেন তারা দরিদ্র মানুষ। তাদের জীবনের যেন কোনও মূল্য নেই প্রশাসনের কাছে। বলা যায় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় পাহাড় কাটার কাজ চলছে। এতে ধসের ঘটনা ঘটে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এসব মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’

চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিবছর বর্ষা আসলে টেনশন, উচ্ছেদের যুদ্ধ বিগ্রহ। অনেক লোকবল লাগে। বর্ষায় হাড় ধসে প্রাণহানি হয়। তবে আমাদেরও ঘাটতি আছে। পাহাড়ে বসতি স্থাপনে শুরুতে আমরা কিছু করি না। ২ থেকে ৫ বছর পর করি। তাতে তারা উৎসাহিত হয়। উচ্ছেদ খুব কঠিন। বসতে না দিলে সব থেকে ভালো’।

 
Electronic Paper