টালমাটাল জামিআ রাহমানিয়া মাদ্রাসা
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ৯:৪৮ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২০, ২০২১
রাতে সরকারের একজন মন্ত্রীর ফোন পেয়ে সকালেই মোহাম্মদপুর জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা ছেড়ে যান মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের ছেলে মাওলানা মাহফুজুল হক। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৮টায় তিনি কিছুসংখ্যক শিক্ষক-ছাত্রের উপস্থিতিতে মাদ্রাসার সব দরজা-জানালা বন্ধ করে মূল ফটকে তালা দিয়ে বেরিয়ে যান। মাহফুজুল হক কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকেরও মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘রোববার রাত ১টা ৫ মিনিটে সরকারের একজন মন্ত্রী তাকে ফোন করেছিলেন। মন্ত্রী বলেছেন, মাদ্রাসায় তালা দিয়ে চাবি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) সভাপতি মাওলানা মাহমুদুল হাসানের হাতে পৌঁছে দিতে। মন্ত্রীর কথার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমরা তালা দিয়েছি। এখন চাবি পৌঁছে দেব।’
প্রায় দুই যুগ জামিআ রাহমানিয়া মাদ্রাসার কর্তৃত্ব নিয়ে শায়খুল হাদিসের পরিবার ও মুফতি মনছুরুল হকদের সঙ্গে বিরোধ চলছিল। ১৯৮৬ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা হয়। দুই পক্ষই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত ছিল। একপর্যায়ে কমিটি নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে তা আদালতে গড়ায়। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে আল্লামা আজিজুল হক মাদ্রাসাটির প্রধান মুরব্বি বা ??শায়খ পদে ছিলেন। পরে কিছুদিন মাদ্রাসার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ২০ বছর ধরে শায়খুল হাদিসের ছেলে মাওলানা মাহফুজুল হক এর অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন। বর্তমানে কারাবন্দি হেফাজতে ইসলামের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকও এ মাদ্রাসারই শিক্ষক ছিলেন।
জানা গেছে, স্থানীয় তিনজন ব্যক্তি জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য ১৬ কাঠা জমি ওয়াকফ করেছিলেন। ওয়াকফ করার সময় দলিলে ওয়াকফকারীরা মোতোয়ালি হিসেবে থাকবেন, এমন কিছু ছিল না। তিনজন ওয়াকফকারীই মারা গেছেন। তবে জীবিত থাকতে ওয়াকফকারীদের একজন শায়খুল হাদিসদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার অভিযোগে তাদের উচ্ছেদের জন্য ওয়াকফ এস্টেটে মামলা করেন। তিনি মুফতি মনছুরুল হকদের পক্ষ নেন। শেষ পর্যন্ত মনছুরুল হকরা ওয়াকফ প্রশাসকের রায় পান। সে অনুযায়ী ওয়াকফ প্রশাসন থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে একাধিকবার দখলদারদের উচ্ছেদ করার আবেদন জানানো হয়। এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করেন মাহফুজুল হকেরা। মামলাটি এখনো বিচারাধীন।
মাহফুজুল হকের ভাই মামুনুল হককে গ্রেফতারের পর বিষয়টি নতুন করে গতি পায়। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয় মাহফুজুল হকদের মাদ্রাসা থেকে উচ্ছেদে। কিন্তু মামলাটি বিচারাধীন থাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো যাচ্ছিল না। এরই মধ্যে কয়েক দিন ধরে গুঞ্জন ছিল যে পুলিশ যে কোনো সময় উচ্ছেদ অভিযান চালাবে। মাদ্রাসার সামনে পুলিশ সদস্যদের সংখ্যাও আগের চেয়ে বাড়ানো হয়। মাদ্রাসা থেকে বের হওয়ার আগে সকালে মাহফুজুল হক ফেসবুক লাইভে জানান, তারা মাদ্রাসা ছাড়ার ব্যাপারে আদালত থেকে কোনো নোটিস পাননি।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মাহফুজুল হকের অনুরোধে এ বিষয়ে রোববার রাতে বেফাকের সভাপতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মুফতি রুহুল আমিন, মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ ও হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব নূরুল ইসলাম জেহাদিসহ কয়েকজন আলেম বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকে মুফতি মনছুরুল হককে থাকতে বলা হলেও তিনি যাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈঠকে উপস্থিত থাকা একজন আলেম অভিযোগ করেন, সরকার মাহফুজুল হকদের উচ্ছেদ করবেইÑএটাই সরকারের সিদ্ধান্ত। কিন্তু তারা এই সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে উচ্ছেদ করতে কিছুটা অনাগ্রহী। সরকার চায়, মাহফুজুল হকরা যেন নিজেরাই মাদ্রাসা ছেড়ে যান। বৈঠকে উপস্থিত থাকা এক আলেম জানান, তাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে তারা এ বিষয়ে একতরফা কোনো সমাধানে জড়াবেন না। কারণ এ রকম কিছু করতে হলে সরকার ও আদালতই যথেষ্ট। সেখানে শুধু শুধু তাদের জড়ানোর দরকার কী। তা ছাড়া তারা যতটুকু জেনেছেন, তাতে বিষয়টি এখনো আদালতে চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়নি।
বেফাকের সভাপতি মাওলানা মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমি কোন অধিকারে মাদ্রাসার চাবি নেব? বিষয়টি আদালতের। আমাকে চাবি নিতে হলে আগে বিষয়টি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে হবে এবং এর একটি রেজল্যুশন লাগবে। বিষয়টি বোর্ডের কাছে হাওলা করা হলে বোর্ড একটা সুন্দর সমাধানের চেষ্টা করবে।’
মাওলানা মাহমুদুল হাসান কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পাশাপাশি সরকার স্বীকৃত আল হাইআতুল উলয়ারও চেয়ারম্যান।
শায়খুল হাদিসের পরিবারের একটি সূত্র জানায়, তারা চাবি রাখুক বা না রাখুক, তারা মাওলানা মাহমুদুল হাসানের কাছে চাবি পৌঁছাবেন। মাদ্রাসার আসবাবপত্র, বই-পুস্তক সরাবেন না। তাদের অবর্তমানে কেউ মাদ্রাসা দখল করে নিলে সেটা সরকারের দায়িত্ব। বর্তমানে জামিআ রাহমানিয়া মাদ্রাসায় ১২ শত ছাত্র এবং ৮০ জন শিক্ষক রয়েছেন বলে জানান মাওলানা মাহফুজুল হক। এ রকম টালমাটাল অবস্থায় মাদ্রাসাটির ছাত্র-শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।