পুরান ঢাকায় অবৈধ কেমিক্যাল ব্যবসা
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:২২ পূর্বাহ্ণ, মে ০৮, ২০২১
পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। ঘটছে অগ্নিকা-, মারা যাচ্ছে মানুষ, নিঃস্ব ও অসহায় হচ্ছে নিহতের পরিবার। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতা ও তদারকির অভাবে ঘটছে এসব, বলে মনে করছেন অনেকে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের অবস্থান শনাক্ত ও সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি বলছেন, অবৈধ কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সরাসরি নজরদারি প্রয়োজন। তবেই পুরান ঢাকাকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হবে। বিভিন্ন অগ্নিকা-ে পুরান ঢাকায় যে নিহতের ঘটনা ঘটে তা অবহেলাজনিত হত্যাকা-ের শামিল বলেও মনে করেন তারা।
গত এক দশক আগে ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর আগুনে মারা যান ১২৪ জন। চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আগুনে নিহত হন ৭১ জন। এ বছর আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানশনের আগুনের ঘটনায় মারা যান ছয়জন। সব ঘটনার স্থান একই-পুরান ঢাকা?। আর আগুন লাগার পর প্রতিবারই আলোচনায় আসে অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউনের কথা।
বড় এসব আগুনের ঘটনা নজরে আসলেও ধামাচাপা দেওয়া হয় ছোটখাটগুলোকে, বলছেন স্থানীয়রা। নিজেরা উদ্যোগী হয়ে থামানো হয় আগুন। তারা আরও বলেন, বড় ঘটনা ঘটলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। ফের গুটিয়ে যায়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার কর অঞ্চল ৩, ৪ ও ৫ এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে ১৯২৪টি কেমিক্যাল গোডাউনের সন্ধান পাওয়া গেছে। কেমিক্যালের ধরন ও ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় মাঝারি আকারের ঝুঁকিতে থাকা গোডাউনের সংখ্যা ৯৮ শতাংশ। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ০.৫ শতাংশ, নি¤œ ঝুঁকিপূর্ণ ১.৫ শতাংশ। এসব তথ্য জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সম্প্রতি একটি চিঠি দিয়েছে ডিএসসিসি। তালিকা তৈরিতে সহায়তা করেছে ফায়ার সার্ভিস অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর, শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নুরুল মোস্তফা বলেন, ‘২০২২ সালে স্থানান্তরের আগ পর্যন্ত আমাদের ব্যবসা পরিচালনা প্রক্রিয়া কেমন হবে তা নিয়ে এখনও নির্দেশনা পাইনি। আমরা নিজেরাও শঙ্কিত। বিভিন্ন সময় অগ্নিকা-ের পরই কেমিক্যাল গোডাউনগুলোতে অভিযান শুরু হয়। সরিয়ে ফেলতে বলা হয় গুদাম। কিন্তু কোথায় সরানো হবে তা কেউ বলে না। এখন শুনতে পাচ্ছি সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আবারও অভিযান হবে।’
ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে কোনও অনুমতি ছাড়াই কীভাবে এসব দ্রব্য আমদানি হয়, কীভাবে গুদামজাত হয় ও কীভাবে ব্যবসা চলে আসছে? দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ যতোক্ষণ না কাজ না করবে ততোক্ষণ সমস্যা রয়ে যাবে।’
বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘লাইসেন্স দেওয়ার পর মনিটরিংয়ের সুযোগ আমাদের কম। কোনও ব্যবসায়ী যখন আবেদন করেন, সেই সময় আমরা কাগজপত্র ও অবকাঠামো যাচাই করে লাইসেন্স দিই। লাইসেন্স দেওয়ার পরে মনিটরিংয়ের তেমন সুযোগ থাকে না। চুড়িহাট্টার ঘটনার পর থেকে পুরান ঢাকায় কিন্তু আমাদের কোনও লাইসেন্সই দেওয়া হয়নি।’
এদিকে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের স্থানান্তরের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিভিন্ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে এগোচ্ছে না সেই কাজ। মুন্সীগঞ্জে ৩০০ একর জমির ওপর নির্মিতব্য কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ এলাকায় ২০২২ সালের আগে যেতে পারবেন না পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমিটিতে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। ২০২২ সালের জুনে শেষ হবে প্রকল্পের কাজ।
স্থানান্তর প্রকল্প নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব, ‘এক সংস্থা আরেক সংস্থার ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। শুরু হয় লোক দেখানো অভিযান।’ তিনি বলেন, ‘মনিটরিংয়ের অভাব, নানা সিদ্ধান্ত কার্যকর না করা এবং সর্বোপরি এসব মৃত্যুগুলোকে আমলে না নেওয়ার কারণেই অগ্নিকা-ের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।’
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক মুন্সীগঞ্জের প্রকল্প পরিচালক সাইফুল আলম বলেন, ‘প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। এটা শেষ হলেই রাস্তা, ড্রেন-কালভার্ট করে প্লট করা হবে। এরপরই বরাদ্দ দেওয়া যাবে। কাজ শেষ হতে ২০২২ সালের জুন লেগে যাবে। শিল্পনগরী সম্পন্ন হওয়ার পর একটি নীতিমালা হবে বলেও জানান তিনি।’