ছোটদের বড় অপরাধ
এম কবীর
🕐 ১০:২২ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৯
রাজধানীতে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং কালচার। এলাকায় প্রভাব বিস্তার, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা ও হত্যাসহ বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে তিনশ’র অধিক গ্যাং কালচার সদস্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, আইনের কাছে অপরাধ অপরাধই। হোক সেটা ছোট কিংবা বড়। একজন অপরাধীকে অপরাধের বিবেচনায় আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিশোর অপরাধের দায় নিতে হবে পরিবার আর রাষ্ট্রকেই। তবে এই গ্যাং তৈরির নেপথ্যে কারা তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকাসহ সারা দেশে এই গ্যাং কালচার বিস্তৃত থাকলেও ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান হত্যার পর আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাং কালচারের বিষয়টি। বিভিন্ন বাহিনীর অভিযানের পর বর্তমানে প্রায় পঞ্চাশের অধিক গ্যাংয়ের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তার মধ্যে ডিসকো বয়েস, নিউ নাইন স্টার, নিউ আইকন, ফাস্ট হিটার বস, তুফান গ্রুপ, স্টার বন্ড, মোল্লা রাব্বী, বাংলা গ্রুপ, লারা দে গ্রুপ, ভাণ্ডারী গ্রুপ, যমজ ভাই, ডেবিল কিং ফুল পার্টি ছাড়াও বেশ কিছু কিশোর গ্যাং আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এলাকাভিত্তিক অপরাধ, প্রভাব বিস্তার, ইভটিজিং ও মাদক ব্যবসাসহ খুন-খারাবির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তারা।
সর্বশেষ মোহাম্মদপুরে মহসীন আলী নামে এক কিশোর নিহত হয়েছে এই ধরনের গ্যাং কালচারের কারণে। যারা এসব কালচারের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে তাদের বেশিরভাগের বয়সই ১৮ বছরের নিচে।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় উঠতি বয়সী ছেলেদের মধ্যে যে ‘গ্যাং কালচার’ গড়ে উঠেছে, সেটি কঠোরভাবে দমন করার জন্য গত জুলাই মাসে পুলিশ সদর দফতরে আয়োজিত ত্রৈ-মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. জাবেদ পাটোয়ারী বাহিনীর প্রতিটি ইউনিটকে কিশোর গ্যাং দমনে কঠোরভাবে নির্দেশনা প্রদান করেন। তারই ধারাবাহিকতায় কিশোর অপরাধ দমনে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা প্রতিনিয়তই অভিযান পরিচালনা করে জড়িতদের গ্রেফতার করছে। তারপরও গ্যাং কালচার সদস্যরা তাদের কার্যক্রম প্রকাশ্যে চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এখন থেকে প্রশাসনও কঠোর হতে বাধ্য হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এক কঠোর নির্দেশনা দিয়ে জানিয়েছেন, ‘সন্ধ্যার পর কোনো কিশোর বাড়ির বাইরে থাকবে না।’ নিরাপত্তা বাহিনী যথেষ্ট সজাগ ও সতর্ক রয়েছে কিশোর অপরাধে। অপরাধী যেই হোক, তার বয়স যাই হোক, তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা আছে।
অন্যদিকে, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানিয়েছেন, কিশোর গ্যাং বলি আর বড় গ্যাং বলি-ঢাকায় গ্যাং বলে কোনো শব্দ থাকবে না। সবাইকে নিশ্চিহ্ন করা হবে। গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে ডিএমপি শূন্য সহিষ্ণু নীতি অবলম্বন করেছে। ঢাকায় কোনো গ্যাং থাকবে না।
কিশোর গ্যাং নিয়ে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, অপরাধ অপরাধই। সেটা ছোট কিংবা বড় বলে কিছু নেই। এই সব কিশোর ছোট হয়েও কিন্তু বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। তাদের এখনই যদি এই পথ থেকে বের করে নিয়ে আসা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে ওরা বড় কোনো ক্রাইমের সঙ্গে জড়াবে না এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। গ্যাং কালচারের অনেক সদস্য না জেনেই বড়দের সঙ্গে জড়িয়ে এলাকার প্রভাব খাটাতে দলে ভিড়ছে। এরপর দলে ভিড়েই তারা বাধ্য হচ্ছে নানান অপরাধের সঙ্গে নিজেদের জড়াতে।
অনেকেই আবার অভাবের তাড়নায় বা পরিবারের নানান দ্বন্দ্বের কারণে এই পথ বেছে নিচ্ছে বলেও জানান তিনি। মূলত আড্ডা দিতে দিতেই এক সময় প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। তাই এ ধরনের গ্যাং কালচার রোধে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা ছাড়া এর কোনো বিকল্প পথ নেই বলেও জানান তিনি।
মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, পরিবারের সঠিক নজরদারির অভাবেই বাড়ছে কিশোর অপরাধ। তাছাড়া সমাজের অস্থিরতা ও সামাজিক অনুশাসনের কারণেই এ ধরনের কালচারের আবির্ভাব বলেও জানান তারা। তবে কিশোররা কেন অপরাধে জড়িত হচ্ছে এবং এদের নেপথ্যে কারা সেটি বের করতে পারলে সমাজ থেকে গ্যাং কালচার দূর করা সম্ভব। পরিবার ও রাষ্ট্র কোনোভাবেই এসব অপরাধের দায় এড়াতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রধান ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. জিয়া রহমান বলেন, একটি আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় গ্যাং কালচার নামে একটি উপসর্গ দেখা গিয়েছে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অশনি সংকেত। অল্প বয়সেই তারা হত্যার ন্যায় ঘটনা ঘটিয়ে বড় অপরাধে জড়াচ্ছে।
পরিবার ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ইতিবাচক পদক্ষেপ ও স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর উদ্যোগ ছাড়া গ্যাং কালচার রোধ সম্ভব হবে না। সন্তান কী করে, কার সঙ্গে মেশে কোথায় সময় কাটায়- এ কয়টি বিষয়ে মনিটরিং করতে পারলেই গ্যাংয়ের মতো বাজে কালচারে সন্তানের জড়িয়ে পড়া রোধ সম্ভব বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তাছাড়া ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষাও নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। তাই কিশোর অপরাধ দমনে শুধু আইন প্রয়োগ নয় সামাজিক সচেতনত