পুরান ঢাকা ঢেলে সাজানোর দাবি
সাইদ রহমান
🕐 ১০:৩৪ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৯
৪০০ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির পুরান ঢাকা। জরাজীর্ণ ভবন, অপ্রশস্ত রাস্তা, ঘিঞ্জি পরিবেশসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে প্রায়ই এখানে দুর্ঘটনা ঘটে। যার সর্বশেষ নজির চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। এ ঘটনার পর বিভিন্ন মহল থেকে পুরান ঢাকাকে ঢেলে সাজানোর দাবি উঠেছে। যদিও এর আগে একবার এমন একটি পরিকল্পনা বেশ কিছুদূর এগুনোর পর থমকে যায়। আটটি মেট্রোপলিটন থানা এলাকা নিয়ে গঠিত পুরান ঢাকা নানা সমস্যায় জর্জরিত। ভবনগুলোর বেশির ভাগই জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। পুরান আমলের ভবনগুলোর অনুমোদন তো নেই-ই, গত এক-দুই দশকে নতুন করে গজিয়ে ওঠা অধিকাংশ ভবনই কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি। তাতে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়েছে।
রাস্তাগুলো খুবই সংকীর্ণ। দু-একটি প্রধান সড়ক ছাড়া পুরান ঢাকার কোনো সড়ক ১০ ফুটের বেশি প্রশস্ত নয়। এসব সড়কে দুটি রিকশা পাশাপাশি চলাই দায়। অটোরিকশা বা ছোট গাড়ি ঢুকলে যানজটে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে। এসব সরু রাস্তার পাশেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ি, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, আড়ত, গ্যারেজ, মার্কেট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি। ফলে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। অলিগলি পেরিয়ে ৭০ শতাংশ বাড়িঘর পর্যন্ত পৌঁছে না অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডেও ঘুরেফিরে এই সমস্যার কথা সামনে এসেছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক এ কে এম শাকিল নেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এখানে রাস্তা সরু, পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি নেই, বৈদ্যুতিক ওয়ারিং এলোমেলো। যার কারণে অগ্নিনির্বাপণ করতে গিয়েও আমরা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি।’
রাজউকের পক্ষ থেকে পুরান ঢাকার সমস্যাগুলোকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সেগুলো হলো-আবাসন; পুরনো, জরাজীর্ণ ভবন, অপর্যাপ্ত আলো বাতাস; অতি ঘিঞ্জি পরিবেশ; অপরিকল্পিত, ফুটপাতবিহীন, সংকীর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা; অপরিকল্পিত, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা; ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা; অপর্যাপ্ত, অস্বাস্থ্যকর পানি সরবরাহ; অপ্রতুল খোলা জায়গা ও অপ্রতুল গাছপালাহীন পরিবেশ; ভূমিকম্প ও অগ্নিদুর্ঘটনার অতিমাত্রার ঝুঁকিযুক্ত এলাকা; দূষণযুক্ত পরিবেশ; অপরিকল্পিত, অপর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধাদি।
এর বাইরে আতঙ্ক হিসেবে পুরান ঢাকার অলিগলিসহ প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে ছড়িয়ে আছে রাসায়নিক পণ্যের বৈধ-অবৈধ গুদাম। নানা সময় এগুলো সরানোর কথা এলেও সেটি কার্যকর করা হয়নি। ফলে ছোট-বড় মিলিয়ে দুর্ঘটনা এখানে নিয়মিত বিরতিতেই ঘটে চলেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবমিলিয়েই পুরান ঢাকার একটা পুনর্গঠন প্রয়োজন। শুরুতেই অবকাঠামোর দিকটাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারলে অন্যান্য দিকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সহজ হবে। আর যদি তা না করা যায় তবে ছোটখাটো সংস্কারে পরিস্থিতির বিশেষ কোনো উন্নতি হবে না। এক কথায় পুরান ঢাকার জন্য প্রয়োজন আমূল সংস্কার।
রি-ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকাকে যে আমূল বদলে দেয়া যায়, তার উদাহরণ হিসেবে সিঙ্গাপুরের প্রসঙ্গ টেনে নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এটা সম্ভব এবং এটার সম্ভাবনাও আছে। আজকে আমরা সিঙ্গাপুরের যে অবস্থা দেখি, তার শতভাগ ল্যান্ড রি-ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে হয়েছে। চীনের বেইজিংসহ বেশ কিছু জায়গাতেও এটা হয়েছে। আজ হোক কাল হোক ক্রমান্বয়ে গোটা পুরান ঢাকাকে এভাবে নবায়ন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প দেখি না।’
পুরান ঢাকার আমূল সংস্কারের প্রসঙ্গটি আগেও একাধিকবার আলোচনায় এসেছিল। বছর দুই আগে পরিকল্পনা এগিয়ে গিয়েছিল অনেক দূর পর্যন্ত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কাগজে-কলমেই থেকে গেছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খোলা কাগজকে বলেন, ‘চকবাজারের চুড়িহাট্টায় যে বিভীষিকাময় ঘটনা ঘটে গেল, তাতে আর সময়ক্ষেপণ করা উচিত হবে না। থেমে যাওয়া মহাপরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে মাঠে নামতে হবে। আমি মনে করি, এবার বাসিন্দাদের টনক নড়বে। পুরান ঢাকাকে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি। নতুনভাবে উদ্যোগ নিয়ে আমরা দ্রুত আবার কাজ শুরু করতে চাই। এজন্য রাজউকের পাশাপাশি সব অংশীজনের সাহায্য কামনা করছি।’
পুরান ঢাকাকে ঢেলে সাজানো সময়ের দাবি : রাজউক চেয়ারম্যান
পুরান ঢাকার রি-ডেভেলপমেন্ট নিয়ে ভাবনাটা আজকের নয়। নানা মহল থেকে এর আগেও একাধিকবার দাবি উঠেছিল। বছর দুই আগে এই পরিকল্পনাটা আমরা অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছিলাম। একাধিক সার্ভে করেছিলাম। নকশা চূড়ান্ত হয়েছিল। মেয়রের সঙ্গে এ নিয়ে অনেকবার মিটিংও করেছি। তিনি পরিকল্পনা দেখে উৎসাহী হয়েছিলেন। পুরান ঢাকার যারা বাসিন্দা, তাদের বুঝিয়েছি, তারা রাজিও হয়েছিলেন। কথা দিয়েছিলেন তারা আমাদের সাহায্য করবেন। কিন্তু কাজটা যখন শুরু করব, ঠিক তার আগে তারা তাদের কথা থেকে সরে দাঁড়ালেন। বললেন, ঠিক এখনই নয়, আরও কিছুদিন দেখি। এমন মাস্টার প্ল্যানে যদি বাসিন্দাদের সাহায্য না পাই তাহলে কাজটা ঠিকভাবে করা সম্ভব নয়...এমন ভাবনা থেকে পুরান ঢাকাকে ঢেলে সাজানোর প্রকল্পটি তখনই থেমে যায়। বাসিন্দাদের আমরা এও বলেছিলাম, আপনাদের কোনো টাকা পয়সা দিতে হবে না, কাজটা আমরাই করব। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তারা আমাদের সাহায্য করল না।
চকবাজারের চুড়িহাট্টায় যে বিভীষিকাময় ঘটনা ঘটে গেল, তাতে আর সময়ক্ষেপণ করা উচিত হবে না। আমি মনে করি, এবার বাসিন্দাদের টনক নড়বে। পুরান ঢাকাকে ঢেলে সাজানো এখন সময়ের দাবি। নতুনভাবে উদ্যোগ নিয়ে আমরা দ্রুত আবার কাজ শুরু করতে চাই। এজন্য রাজউকের পাশাপাশি সব অংশীজনের সাহায্য কামনা করছি। এটি যদি সফল করতে পারি তাহলে বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনার ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ হবে।