ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মিরপুরে সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে হত্যা

রাজু আহমেদ, মিরপুর
🕐 ১:৫৬ অপরাহ্ণ, মে ২২, ২০২৩

মিরপুরে সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে হত্যা

রাজধানীর মিরপুরের দারুসসালামে চিহ্নিত কিশোর গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে সিয়াম (১৪) নামে সপ্তম শ্রেনীতে পড়ুয়া এক কিশোর নিহত হয়েছে। গতকাল ২১ মে (রোববার) দিবাগত রাত আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে মিরপুরের দারুসসালাম থানাধীন লালকুঠির বসুপাড়া এলাকায় এঘটনা ঘটে।

নিহত কিশোর সিয়াম লালকুঠি বসুপাড়া এলাকার মোঃ আমিন ও স্বপ্না দম্পতির একমাত্র সন্তান এবং সে স্থানীয় লালকুঠি এলাকার কবি নজরুল উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী।

চলতি মাসেই অর্থাৎ গত ৪ মে বিকেলে দারুসসালাম থানাধীন বাগবাড়ী এলাকায় কবিরুল ইসলাম অপু নামে এক ব্যবসায়ীকে তার মায়ের সামনেই একইভাবে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছিলো বলে জানা গেছে। সেই নৃশংস হামলার ঘটনায় ভুক্তভোগী অপু প্রাণে বেচে গেলেও তার একটি হাতে বৃদ্ধাঙ্গুলি হারানোসহ তার ডান হাতে পেশীর হাড় ভেঙে যায়। তার ঘাড়ে স্পর্শকাতর স্থানে দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে গভীর ক্ষত সৃষ্টির কারণে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে প্রাণে বেঁচে যান তিনি।

দুই সপ্তাহের ব্যবধানে একইভাবে প্রায় একই এলাকাতে হামলার শিকার হলেন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া কিশোর সিয়াম (১৪)। তবে সেই হামলায় গুরুতরভাবে আহত অপু প্রাণে বেঁচে গেলেও একইভাবে হামলার শিকার কিশোর সিয়াম তার মায়ের বুক খালি করে, দুনিয়ার সকল মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে নৃশংস হামলার পরপরই অকালে মর্মান্তিক মৃত্যুকে বরণ করে নিতে বাধ্য হলো।

নিহত সিয়ামের পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী ও দারুসসালাম থানা সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে অজানা কারণে আকস্মিক হামলার শিকার ভুক্তভোগী সিয়ামের ডাক চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে মারাত্মক আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় আহত সিয়ামকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আইনগত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত ও ময়না তদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে রাখা সিয়ামের লাশের পেটে, নাভীর ঠিক চার আঙ্গুল ওপরে ধারালো অস্ত্রের কোপে সৃষ্ট গভীর ক্ষত লক্ষ্য করা গেছে। ছুরিকাঘাতে পেটের ভেতরে অবস্থিত মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ পাকস্থলীতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নিহত সিয়ামের বন্ধু, লালকুঠির রজনীগন্ধা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সীতল হোসেন বলেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যার পূর্ব থেকেই নিহত সিয়াম, সীতল ও আসিফ আহমেদ নামে আমরা তিন বন্ধুসহ আরো ১৫/৩০ জন বন্ধুবান্ধব একই সাথে ছিলাম। সন্ধ্যার পর আনুমানিক রাত আটটা সাড়ে আটটার দিকে হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ায় অদূরের বসুপাড়ার আমাদের পরিচিত একটি আম গাছ থেকে আম পড়েছে ভেবে আম কুড়িয়ে পাওয়ার লোভে তিনজনই একসাথে সেই আম গাছটির নিচে পৌঁছাই। কিন্ত গাছের নিচে কোনো আম না পেয়ে আমরা গাছটি থেকে দু'চারটি আম পেড়ে নিয়ে আসতে চেষ্টা করি। এসময়ে লাইটের আলোতে আমরা দেখতে পাই দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কিছু যুবক আমাদের দিকেই তেড়ে আসছে। লাইটের আলো ছিলো বিধায় অস্ত্রশস্ত্র হাতে আমাদের দিকে তেড়ে আসা বিশ থেকে পঁচিশজনের গ্রুপের সামনে থাকা রকি, ফরিদ, রুবেল ওরফে পটেটো রুবেল, ইমরান ও জার্মানি মাসুদকে দেখে আতংকে দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে যাই।

এঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী আসিফ আহমেদ (১৪) নামে নিহত সিয়ামের অপর এক বন্ধু বলেন, এসময় আগত দেশীয় অস্ত্র সজ্জিত ২০/২৫ জনের সমন্বয়ে গ্রুপের সামনের ব্যাক্তিদের চিনতে পেরে আমরা সেখান থেকে তাৎক্ষণিকভাবে দৌঁড়ে পালিয়ে যাই। কিন্ত এসময় সিয়াম যে আমাদের সাথে দৌড়ে আসতে না পেরে পেছনেই রয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল করিনি। পরে আমরা জানতে পারি সিয়ামের পেটে তারা ছুড়িকাঘাত করে মারাত্মক আহত করে অস্ত্রধারীরা পালিয়ে গেছে।

এঘটনায় দারুসসালাম থানা পুলিশ ঘটনাস্থলের আশপাশের একটি সিসি ফুটেজ সংগ্রহ করেন। দারুসসালাম থানা পুলিশের বর্ণনা ও প্রাপ্ত ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে এক যুবক ছুড়ি সদৃশ দেশীয় অস্ত্র হাতে অপর একজন কিশোরের ঘাড় শক্ত করে ধরে জোরপূর্বক সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। এসময় আরো বেশকিছু যুবক তাদের পেছন পেছন যাচ্ছেন।

এবিষয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে গিয়ে সারারাত থানা কম্পাউন্ডে অবস্থানকালে ভোর আনুমানিক চারটার দিকে থানার কম্পিউটার রুমের ভেতরেই দারুসসালাম থানা পুলিশের ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মোঃ জামাল উদ্দিন ও ঘটনার তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দারুসসালাম থানার এস.আই সোহান আহমেদের উপস্থিতিতে এই সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নিহত সিয়ামের মা স্বপ্না বেগম বুকফাঁটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি দাবি করেন, ঘাড় ধরে জোরপূর্বক সামনের দিকে নিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া কিশোরই তার আদরের সন্তান সিয়াম (১৪)। অস্ত্র হাতে তার ঘাড় শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া যুবকের নাম ইমরান (২৩) ও তার পাশের যুবকের নাম আলী (২৫)। তারাই তার সন্তানকে নৃশংসভাবে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছেন বলে দাবি তুলে তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে থানার কম্পিউটার রুমের ভেতেরই আহাজারি করতে থাকেন স্বপ্না বেগম।

উল্লেখ্য, এর ঘন্টা খানেক পূর্বে অর্থাৎ রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে সংশ্লিষ্ট ঘটনায় সংবাদ প্রকাশের শর্তে থানার অফিসার ইনচার্জের বক্তব্য জানতে জনপ্রিয় সময় টেলিভিশনের প্রতিবেদক কাউসার আহমেদ, যমুনা টেলিভিশনের প্রতিবেদক শাকিল আহমেদসহ বেশ কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিক থানার দোতলায় অবস্থিত ওসি সাহেবের রুমে প্রবেশ করেন। এসময় ওসি আমিনুল বাশারের চেয়ারে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের দারুসসালাম জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মফিজুর রহমান পলাশ, সামনের সোফায় দারুসসালাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আমিনুল বাশার, এর পাশের সোফায় নিহত সিয়ামের মা স্বপ্না বেগম এবং অপর সোফায় হাতে ব্যাণ্ডেজ লাগানো অবস্থায় ইমরান নামে এক যুবকের পাশে আলী (২৫) নামে অপর এক যুবককে বসে থাকতে দেখা যায়।

এরপর ভোরবেলায় পুলিশের উদ্ধারকৃত সিসিটিভি ফুটেজের ভিডিওচিত্র দেখামাত্রই নিহত সিয়ামের মা স্বপ্না বেগম আকস্মিক ভয়ানক আর্তচিৎকার শুরু করে দেন। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এসময় উপস্থিত সকলের সামনেই স্বপ্না বেগম একটি কথাই বার বার বলতে থাকেন, আমার ছেলের খুনিরা থানার ওসি সাহেবের রুমে ওসি সাহেবের সামনেই সোফায় সম্মানের সাথে বসে থাকার ক্ষমতা কোথায় পেলো? এসময় উপস্থিত পুলিশের সকল সদস্য ও স্থানীয় সাংবাদিকদের সামনেই বুক চাপড়ে চিৎকার করে নিহত সিয়ামের মা সপ্না বেগমকে একই কথাই বলতে শোনা যায়, ওরাই আমার বুকের ধনকে খুন করেছে। ওদেরকে পুলিশের কাস্টডিতে না রেখে বরং সম্মানের সাথে থানার ওসির রুমে ওসির সামনের সোফায় বসিয়ে রাখা মানে আমি সঠিক বিচার পাবোনা৷

তিনি আরো বলেন, আমার সন্তানের মরদেহ হাসপাতালের মর্গে রেখে পাহাড় পরিমাণ দুঃখ নিয়ে মাঝরাতে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে আসলেও রাত পেরিয়ে সকাল পর্যন্তও আমার অভিযোগ গ্রহণ করছেনা পুলিশ।

নিহত সিয়ামের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত ও ময়নাতদন্তের প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে দায়িত্ব পালনকারী ও ঘটনাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা দারুসসালাম থানার এস. আই সোহান আহমেদের নিকট এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সোজাসাপটা বলেন, ওসি স্যারের নির্দেশ ছাড়া এঘটনা সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে এই মূহুর্তে গণমাধ্যমকে তিনি কিছুই বলতে পারবেননা।

এবিষয়ে দারুসসালাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আমিনুল বাশার গণমাধ্যমকে বলেন, ইতোমধ্যে নিহত কিশোর সিয়ামের মা স্বপ্না বেগম বাদী হয়ে রুবেল ওরফে পটেটো রুবেল (২৫), আল-আমীন (২২), ইমরান (২৬), রকি (২৩), ফরিদ (২৬), মাসুদ ওরফে জার্মান মাসুদ (২৬), আলীমসহ সাতজনকে এজাহার নামীয় উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ১৫/২০ জনকে আসামী করে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। বাদীর অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত সাপেক্ষে এঘটনায় মামলা রুজুর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

ওসি আরো বলেন, প্রকৃতপক্ষে সিয়াম নামের কিশোরকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট অপরাধীদেরকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে তদন্ত সাপেক্ষে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উৎঘাটনে পুলিশের অবলম্বন করা বিশেষ কৌশলগত কারণে এই মূহুর্তে এবিষয়ে গণমাধ্যমকে বিস্তারিত খুলে বলা সম্ভব হচ্ছেনা।

 
Electronic Paper