রাজধানী জুড়ে সিএনজি নৈরাজ্য
চার লাখের সিএনজি এখন ২৬ লাখ টাকায়
মাহফুজুল আলম খোকন
🕐 ৮:১১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০৯, ২০২২
রাজধানীবাসীর চলাচলের অন্যতম মাধ্যম তিন চাকা বিশিষ্ট চার লাখ টাকার থ্রি হুইলার সিএনজির দাম এখন ২৬ লাখ টাকা। তিন শত টাকা থেকে বাহনটির এখন প্রতি দিনের জমা ২হাজার টাকা পর্যন্ত গড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা হাজার হাজার চালক ও কয়েক লক্ষ যাত্রী।
শোন-হে আমজনতা ভাই, দুঃখের কথার শেষ নাই। কিছু কিছু দুঃখ আছে মনে পড়লে হাসি পায়। আমাদের মহান জাতীয় সংসদে ২০০২ হইতে ১৫ পর্যন্ত, শুভংকরের ফাঁকির মত চার বার হলো আইন পাশ। তবুও বদলায়নী তিন চাকার বাহন সিএনজি চালকও যাত্রীদের ভাগ্যের পরিহাস।
প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে এভাবেই বলছিলেন ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিক্সা চালক ঐক্য পরিষদের এক নেতা ও সিএনজি চালক মোঃ হানিফ শেখ। পেশায় ড্রাইভার হলেও তিনি একজন প্রতিবাদি ও সাহিত্যমনা মানুষ। সিএনজি চালক কর্তৃক যাত্রী হয়রানি বিষয়ে কথা বলতে চাইলে আবেগাপ্লুত হানিফ বলেন, তিনশ টাকার জমা হলো ১৪শ, বহুবার বেড়েছে গ্যাসের দাম। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে নিত্যপণ্যের দাম হুহু করে বারলেও বাড়েনি মিটারের রিডিংরেট। অসাধু দালাল আর সুবিধাভোগী মালিকরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। চার লাখের সিএনজি কিনতে ২৬ লাখ লাগে, এই হচ্ছে আমাদের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।
হানিফ শেখের এসব কবি কথার সূত্র ধরে শুরু হয় খোলা কাগজের অনুসন্ধান। অর্ধশত সিএনজি চালকের ভষ্য মতে ঢাকা মেট্রো থ নাম্বারের সিলিংভুক্ত সিএনজির সংখা সাড়ে চার হাজারের মত। তবে চালকের সংখ্যা তিন গুনেরও বেশী। যথাযত কর্মসংস্থান না থাকায় এই পেশাতেই নিয়োজিত হাজার হাজার চালক। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাতারাতি কিছু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হলেও বছরের পর বছর নিষ্পেষিত হয়েই চলেছেন চালক ও যাত্রীরা।
২ হাজার সালে রাজধানী ঢাকাকে পরিবেশ বান্ধব করতে নিষিদ্ধ করা হয় টু ষ্টক বিশিষ্ট তিন চাকার বেবীটেক্সি, টেম্পু ও মটর সাইকেলের আদলে মিশুক নামক গণপরিবহনগুলো। পরে ২০০২ সাল নাগাদ বিকল্প বাহন হিসেবে রাজধানীতে চালু করা হয় সিএনজি চালিত অটো রিক্সা। দুই ধাপে মোট সাড়ে চার হাজার সিএনজি অটো রিক্সার সিলিং অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি (বিআরটিএ)।
১৫-২০ হাজারের মত বাহন নিষিদ্ধ করে সাড়ে চার হাজার বাহন হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পরে এসব বাহনের চালকেরা, দুর্ভোগে পড়েন লাখ লাখ যাত্রী। ২০০৭ সালে তত্তাবধায়ক সরকার আমলে চালকদের নামে সহজ কিস্তিতে লোনের মাধ্যমে সিএনজি প্রদানের জন্য আন্দোলন করলে গ্রেফতার করা হয় কয়েকজন শ্রমিক ।
পরে বিষয়টির বস্তুনিষ্ঠতা পেলে প্রশাসন স্ব-সম্মানে তাদের মুক্তি দেয়। এক সময় তাদের আন্দোলনের মুখে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে রাজধানীতে ৫ ও চট্রগ্রামে ৪ হাজার চালককে সিএনজি দেয়ার জন্য। সেই আলোকে বাংলাদেশ ব্যংকে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে টাকা জমা নিলেও আজ ১৬ বছর তা বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া ২০১৫ সালের পর সিএনজির মূল্য সরকার চারবার বৃদ্ধি করেছে। অথচ এই মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে যাত্রী ভাড়া সামঞ্জস্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে 'মিটার ক্যালিব্রেশন' করা হয়নি। অপরদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে সিএনজি অটোরিক্সা চালকদের জীবন-জীবিকা ভয়াবহ হুমকির মুখে বলে জানিয়েছেন চালকেরা।
চালকদের ভাষ্য মতে, ঢাকা মেট্রো থ নাম্বারের সিলিং ভুক্ত কিছু সিএনজি বর্তমানে ২ ও তিন শিফটে চলে। ভোর ৫ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত ৭০০ টাকা, এক ঘন্টা রেস্ট নেয়ার পর দুপুর ২টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত ৭০০ টাকা এবং ১০ টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত নাইট শিফটে ৬শ টাকা। তাতে একটা সিএনজি প্রতিদিন ২ হাজার টাকা জমা উঠে। আট ঘন্টায় ৭শ টাকা জমা, তিন শত টাকার গ্যাস ও চালকের রুটি রুজির জোগার করতেই মূলত তারা মিটারে চালাতে পারেন না বলে তাদের অভিযোগ। আবার এর ওপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে জেলার সিএনজিগুলো।
ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুর জেলায় নিবন্ধিত হাজার হাজার সিএনজি অসাধু ট্রাফিক পুলিশ ও লাইনম্যানদের মেনেজ করে মাসুহারা ভিত্তিক দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো রাজধানী। সেই সাথে রয়েছে প্রাইভেটের আদলে ভাড়ায় চালিত সিএনজি অটোরিক্সার দাপট। তথ্য রয়েছে এগুলোও চলে মাসুহারা ভিত্তিতেই। প্রতি মাসে একেকটা বাহন প্রতি গুনতে হয় ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা।
ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিক্সা চালক ঐক্য পরিষদের সচিব আমিনুল ইসলাম খোলা কাগজকে বলেন, আমি যে গাড়িটি চালাই তার জমা দিতে হয় ১১-১২ শ টাকা। যেখানে সরকার নিয়ম করেছেন ৯ শ টাকা। আবার দুই হাত মানে দু’জন একি গাড়ি চালালে দিতে হয় ১৫-১৬ টাকা।
তিনি বলেন দুজন ড্রাইভার গাড়ির জমা দেন ১৫শ, গ্যাস লাগে ৫শ, পকেট খরচ কম করে হলেও ৩শ, গ্যারেজ ভাড়া ৫০-১ শত টাকা দৈনিক খরচ। তারপর আবার একটু নিয়ম নীতির ব্যতিক্রম হলে মামলাতো আছেই। সব মিলিয়ে বাধ্য হয়েই চালকেরা মিটারে সিএনজি চালাতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন তিনি। এদিকে মেট্রো এলাকায় নতুন নিবন্ধন বন্ধ থাকা ও মোটা অংকের ভাড়া পাওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে এর গুরুত্ব ও দাম। মাত্র ৪ লাখ ২০ হাজার টাকার সিএনজি ও ৪০ হাজারের রেজিষ্ট্রেশনের যান্ত্রিক বাহনটির দাম এখন ২৫ ছাড়িয়ে ২৬-২৭ লাখে গড়িয়েছে। তথ্য রয়েছে শুধুমাত্র পুরাতন সেই নম্বর প্লেটটির দাম এখন ১৮-২২ লাখ টাকা।
চালকদের দাবি, সিএনজি অটোরিক্সার ভাড়ার হার মিটারে প্রথম ২ কিলোমিটারে ৮০ (আশি) টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটাওে ৩০ (ত্রিশ) টাকা এবং ওয়েটিং-চার্জ প্রতি মিনিটে ৪ (চার) টাকা নির্ধারণপূর্বক গেজেট/প্রজ্ঞাপন জারি করার দাবিও তাদের। অন্যদিকে সিএনজি অটোরিকশার দরিদ্র চালকদের ক্ষেত্রে যে কোনো মামলার (ম্যানুয়ালি বা পস-মেশিনে) আর্থিক জরিমানার হার ৫০০ টাকার বেশি না করার দাবিও তাদের।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি (বিআরটিএ) এর রোড সেফটি শাখার পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব ই রাব্বানি দৈনিক খোলা কাগজকে বলেন, নতুন করে ঢাকা মেট্রো এলাকায় সিএনজি অটো রিক্সার নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে না। জেলা এলাকার জন্য নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিক্সা মেট্রোতে চলার কোন অনুমতি নেই। চালকদের নামে সহজ কিস্তিতে ঢাকা ও চট্রগ্রামে ৯ হাজার বাহন দেয়ার বিষয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি বলেও জানিয়েছেন তিনি।
তবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী খোলা কাগজের সাথে একান্ত আলাপে বলেন, সিএনজি চালক ও মালিকদের টানাটানিতে দিশেহারা যাত্রী সাধারণ। চালক, মালিকদের দফায় দফায় আবদার রাখলেও উনারা প্রতিনিয়ত নতুন ইস্যু তৈরি করে যাত্রী হয়রানি করছে। উদাহরণ স্বরূপ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কোলকাতায় টেক্সি-ক্যাবের সর্বনিন্ম ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ টাকা আর আমাদের দেশে সিএনজির ভাড়া ৪০ টাকা। সরকারের উচিত এই সেক্টরটাকে যথাযত পরিকল্পনা ও নজারদারির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রেখে যাত্রী সেবা নিশ্চিত করা।