ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, একজনও খারাপ বাবা নেই’

আরিফ জাওয়াদ, ঢাবি
🕐 ৬:১৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২২

‘পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, একজনও খারাপ বাবা নেই’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিস ইসলামের মা নাজমা ইসলামের আত্মহত্যাকে প্ররোচনামূলক আত্মহত্যার আখ্যা দিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষ বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে বুয়েট শিক্ষার্থীরা।

বুধবার (৭ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে ‘বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে এ মানববন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। আমার বন্ধু এতিম কেন জবাব চাই জবাব চাই; আমার বন্ধু ঘরছাড়া কেন জবাব চাই জবাব চাই; স্বামী নির্যাতিতা একজন মায়ের সন্তান বলছি; Say no to domestic violence' ইত্যাদি প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করতে দেখা যায়।

মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের সহপাঠীর (নাফিস ইসলাম) বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। তার ভাষ্য অনুযায়ী তার মা’কে বেশ কয়েকবছর ধরেই নিয়মিত নির্যাতন করত। গত ৩০ মে তার মা আত্মহত্যা করে মারা যান। তার মায়ের শরীরে অনেক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তিনি মারা যাওয়ার আগে একটা সুইসাইড নোট লিখেছেন সেখানে নির্যাতনের কথাও তুলে ধরেছেন। আমরা মনে করি এটি প্ররোচনামূলক আত্মহত্যা। তদন্ত ও যথাযথ বিচার দাবি করছি এবং আমাদের সহপাঠীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।

এসময় বিভিন্ন বিভাগের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে এ ঘটনায় গেল রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের বাবার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে স্টাটাস দেন নাফিস ইসলাম। সঙ্গে সুইসাইড নোট, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এবং তাঁর বাবার ছবি দিয়ে স্ট্যাটাস দেন বুয়েটের ওই শিক্ষার্থী।

স্ট্যাটাসটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল:

“পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে, একজনও খারাপ বাবা নেই।” -হুমায়ূন আহমেদের তিন ডব্লিউ লেখার এই লাইনটা সোশ্যাল মিডিয়ায় খুবই প্রচলিত। আজকে গল্প শুনাই একজন বাবার, আমার বাবার।

আমার বাবা, মোঃ নুরুল ইসলাম, একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। চাকরিজীবন অনেক সুনামের সাথেই পার করেছেন। বাইরের পৃথিবীতে সবাই সম্মানই করতেন, হয়তো তার ব্যবহারে নাহলে তার চাকরিসূত্রে পাওয়া ক্ষমতার ভয়ে। আড়ালে চলে তার পৈতিক গ্রামে সোনা চোরাকারবারী চক্রকে বিভিন্ন পুলিশি সুবিধা প্রদান আর জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীকে ইউপি নির্বাচনে জেতানোর সব রকম অনৈতিক চেষ্টা।

পরিবার জীবনে চিত্রটা আরও ভিন্ন।আমার বাবা মায়ের সম্পর্ক কখনই ভালো ছিল না। ছোট খাটো বিষয়ে আমার বাবার আমার মায়ের প্রতি টর্চার ছিল প্রতিদিনেরই ঘটনা। মধ্যবিত্ত পরিবারে যেটা হয়, আমার মা সব সহ্য করেই ৩৫-৩৬ বছর সংসার করে গেছেন,আমাদের দুই ভাইবোনের কথা চিন্তা করে। আমার বাবার অবসরের পর শুরু হয় তার এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ার আর আমার মায়ের প্রতি অমানুষিক হিংস্রতা। প্রতিদিনই নেশা করে আমার বাবার সকাল বিকাল চলতো আমার মায়ের ছোট খাটো বিষয় ধরে,মিথ্যা অপবাদ দিয়ে শারীরিক মানসিক নির্যাতন।

করোনার সময় লকডাউনে বেড়ে গেল এই হিংস্রতা অনেক গুণ।সে সময়টুকু আমি বাসায় থাকায় যতটুকু পেরেছি সামলানোর চেষ্টা করেছি।উল্লেখ্য আমাদের বাসা রাজশাহীতে,আমি বুয়েটে কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা করি। বড় বোন বিবাহিত, সে শ্বশুড়বাড়ি থাকে। পরিবারের সবাই এটা বিষয়গুলো জানতো,দাদাবাড়ির সবাই ছিল নীরব,নানাবাড়ির কারও সাথে আমার মাকে যোগাযোগ করতে দেওয়া হত না।

কোনোভাবে পরিবারে স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে না পেরে সমাজের তথাকথিত সিনিয়র সিটিজেনদের কাছে যাই যে আমার মাকে বাঁচান।আমার বাবার সহকর্মীদের কাছে আমি এবং আমার বোন যাই। আইনি হোক অথবা পারিবারিক হোক,কোনভাবেই সাহায্য করেন নি।উপায় না পেয়ে আমার মাকে ২০২২ এর জানুয়ারিতে আমার মামার বাসায় পাঠিয়ে দিই,দুইমাস সেখানেই ছিলেন।এ পর্যায়ে আমার বাবা আমার থাকা খাওয়া আর পড়াশোনার খরচ বন্ধ করে দেন। পরে পরিবারের একে ওকে ধরে আমার বাবা আমার মাকে ফিরিয়ে আনেন,আর এই আশ্বাস দেন যে আর শারীরিক নির্যাতন করবেন না।

৩০/০৫/২২ তারিখ দুপুর ২.৪০ এ ক্লাসে আমার কাছে একটা ফোন আসে, জানতে পারি আমার মা আর বেঁচে নেই।নিজেকে সামলে দ্রুততার সাথে রাজশাহী আসি। এসে আমার মায়ের মৃতদেহ দেখি,যে ঘরে আমার মা নামাজ পরতেন,সেই ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে শাড়িতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন, আর তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। আমার বোন আরও আগে পৌঁছেছিল, আপু আমাকে জানায় আঘাতের চিহ্নগুলো আরও পরিষ্কার ছিল আপু যাওয়ার পর পর।

রাজশাহী চন্দ্রিমা থানার পুলিশ আমার আগেই উপস্থিত আমাদের বাসায়। চন্দ্রিমা থানার অফিসার ইনচার্জ এমরান হোসেন এরপর শুরু করলেন আরেক খেলা। আমার মায়ের শরীরের আঘাতের চিহ্নগুলো মৃত্যুর পর শুইয়ে রাখার জন্য হয়েছে এরকম বলতে থাকলো।পুলিশের প্রাথমিক সুরতহাল রিপোর্টেও সেরকমই লেখা হল।জানি না আমার বাবা পুলিশের লোক দেখেই হয়তো পুলিশের এই বিষয়টি এত ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা।

আমার মাকে পোষ্টমর্টেমের জন্য পাঠানো হল রাত আটটার দিকে। এরপর আমার মায়ের লেখা সুইসাইড নোট খুঁজে পাই আমার ড্রয়ার থেকে। যেখানে আমার মা স্পষ্ট লিখে গেছেন তার সাথে কি কি করা হয়েছিল। রাতেই থানায় যোগাযোগ করলাম অভিযোগের জন্য, ওসি এমরান হোসেন নোট দেখে বললেন, এসব অভিযোগ লাগবে না,অপমৃত্যু মামলার তদন্তেই সব বেড়িয়ে আসবে। আমার বাবা তার চাকরিসূত্রে পাওয়া প্রভাব বা টাকার ক্ষমতা দেখানো শুরু করে ফেলল। পরেরদিন ৩১/০৫/২২ তারিখে আমার মায়ের দাফন শেষে আমার বাবার গ্রামের সোনা চোরাকারবারি জামায়াতের দল আমাকে বাড়ি থেকে মারধোর করে বের করে দিল।আমি আমার বোনের কাছে এসে আশ্রয় নিলাম।

আমার বাবার মামাতো ভাই,রাজশাহী মেডিকেলের নিউরো মেডিসিনের অধ্যাপকের অনুরোধে আমার মায়ের পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট দেরী হতে থাকলো, এক মাস পর রিপোর্ট পাওয়া গেল। রিপোর্টে আমার মায়ের শরীরে মারধোরের চিহ্ন স্পষ্ট। এরপর ওসি এবং তার ইনভেস্টিগেটর অফিসার ঘুরাতে শুরু করলো,তারা বলে পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট পায়ই নি। এদিকে আমার বাবা ফোনে আমাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন,রাজশাহী গেলে আমাকে কেটে ফেলে দিবে। পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়ার দুই মাস পর,আমার মা মারা যাওয়ার তিন মাস পর থানা যাও বা স্বীকার করলো পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গেছে, কিন্তু তাদের কিছু করার নেই, কারও বিরুদ্ধে নাকি কোন অভিযোগ হয় না এগুলোর হিসাবে।

আমার দাদাবাড়ির লোকেরা প্রপার্টির লোভে আমাকে দূরে সরাতে পারলে বাঁচে।এক ঝটকায় আমি পরিবারহীন,বাড়িঘরহীন অনাথ হয়ে গেলাম।অভিযোগের জায়গাটা পর্যন্ত নেই।এমন একটা মানুষে পরিণত হলাম যার অস্তিত্ব নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। আমি থাকা বা না থাকা একই কথা। শেষ মুহূর্তে আমার মা কেমন অসহায় একা অনুভব করেছিল সেটা অনুভব করতে পারি। বেঁচে থাকার কোন কারণ কেন খুঁজে পান নি,কেন বেঁচে থাকতে চাননি বুঝতে পারছি।

হুমায়ূন আহমেদ তার তিন ডব্লিউয়ের শেষ পর্যন্ত লিখে গেছেন, "এখন মনে হয় শীলা বুঝে গেছে—পৃথিবীতে খারাপ বাবাও আছে। যেমন, তার বাবা।"

 
Electronic Paper