ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ইমেজ সংকটে বরিশাল মেট্রো ডিবি পুলিশ

হেলাল উদ্দিন, বরিশাল প্রতিনিধি
🕐 ১১:১৮ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ০৯, ২০২১

ইমেজ সংকটে বরিশাল মেট্রো ডিবি পুলিশ

বরিশাল মেট্রো ডিবি পুলিশ এখন নগরীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এসআই মহিউদ্দিনের অপকর্মে ডিবির ওপর আস্থায় ভাটা পড়েছে জনমনে। সম্প্রতি তার মারধরে শিক্ষানবিস আইনজীবী রেজাউল করিম রেজার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় তাকে পুলিশ লাইনসে ক্লোজ করা হলে খুলতে থাকে তার অপকর্ম ও বেপরোয়া কীর্তিকলাপের থলের খবর। এতদিন তার দেখানো ‘ক্রসফায়ারের ভয়ে’ যারা মুখ খুলতে সাহস পাননি, তারাও দিতে শুরু করেছেন তথ্য।

এদিকে, অপকর্ম ঢাকতে এবং মানুষ ও প্রশাসনের দৃষ্টি ঘোরাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজ আইডি থেকে চাকরি জীবনের নানা অর্জন তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন মজিউদ্দিন, বলছেন নগরবাসী। কবে, কখন, কাকে, কী কারণে গ্রেফতার করেছেন, তাও উল্লেখ করছেন ওই পোস্টগুলোতে। তবে হঠাৎ ফুলে ফেঁপে একাকার মহিউদ্দিন তার ‘অবৈধ’ সম্পদের বিষয়ে এখনো কিছু বলেননি।

আর এ বিষয়ে বরিশালের পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বলেছেন, আমরা শুধু তার অপরাধ তথা আইন বহির্ভূত কাজ করেছে কি না, তা খতিয়ে দেখব। তার অবৈধ সম্পত্তি অর্জনের বিষয়টি দেখবে সরকারের অন্য বিভাগ। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে ডিবি পুলিশের এসআই মহিউদ্দিনকে নিয়ে এবার থাকছে মূল প্রতিবেদন।

আতঙ্কের নাম ডিবি মহিউদ্দিন
সাগরদী ধান গবেষণা এলাকার হামিদ খান সড়কের বাসিন্দা ছিলেন রেজাউল করিম রেজা। একই এলাকায় বসবাস এসআই মহিউদ্দিনেরও। প্রথমে কোতোয়ালি মডেল থানা এবং পরে ডিবি পুলিশে কর্মরত অবস্থায় এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেন মহিউদ্দিন। যখন যাকে খুশি গ্রেফতার, মিথ্যা অভিযোগে মামলা, অর্থ আদায়, নির্যাতন-এসব ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ।

শেরেবাংলা সড়কের বাসিন্দা মো. কামাল বলেন, ‘২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি অভিযোগের সাক্ষী দিতে গিয়েছিলাম। কোতোয়ালি থানার তৎকালীন এসআই শামীমের ঘুষ দাবির বিষয়ে অভিযোগ ছিল। থানায় ডেকে নিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারের পর তদন্তভার দেওয়া হয় এসআই মহিউদ্দিনকে। এরপর থেকে কোনো তদন্ত না করে তিনি আমাকে হয়রানি করে চলছেন। কিছুদিন আগেও হুমকি দিয়ে বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে তোমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

রূপাতলী গ্যাসটারবাইন এলাকার বাসিন্দা রিপন মৃধা, রিপন আকন ও আফজাল হোসেন মিলে বিভিন্ন এলাকায় জমির ব্যবসা করেন। এক দিন তাদের ডেকে নেন এসআই মহিউদ্দিন। দাবি করেন তিন লাখ টাকা। না দিলে ক্রসফায়ারের হুমকি দেন।

রিপন মৃধা বলেন, ‘টাকা না দেওয়ায় ২০১৬ সালের ১৯ অক্টোবর আফজাল হোসেন ও ২৭ অক্টোবর রিপন আকনকে মিথ্যা মামলা দিয়ে থানায় নিয়ে ঝুলিয়ে মারধর করা হয়। এরপর নাকে-মুখে গরম পানি ঢেলে শেখানো স্বীকারোক্তি আদালতে দিতে বাধ্য করা হয়। রূপাতলী ২৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাহাবুব মোল্লাকেও ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়েছিল মহিউদ্দিন।

মাহাবুব মোল্লার স্বজনরা জানান, ‘২০১৬ সালের শেষের দিকে উকিলবাড়ি সড়কের একটি জমি নিয়ে দ্বন্দ্বে মাহাবুব মোল্লাকে প্রকাশ্যে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়েছিল মহিউদ্দিন।’

হয়রানি থেকে রেহাই পাননি ২৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনিছুর রহমানও।

তিনি বলেন, ‘যেখানেই জমি ক্রয়-বিক্রয় হতো, সেখানেই নাক গলাত মহিউদ্দিন। ২০২০ সালের মাঝামাঝি আমার ওয়ার্ডে একটি জমির বিরোধ নিয়ে সালিশি করতে গিয়ে টাকা দাবি করেন মহিউদ্দিন। সেখানে অস্ত্রের ভয় দেখান তিনি। এমনকি ক্রসফায়ারেরও হুমকি দেন।’

রূপাতলি চান্দু মার্কেট শেরেবাংলা সড়কের বাসিন্দা হারিছুল ইসলাম জানান, ‘শেরেবাংলা সড়কে আমার পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত জমিতে নজর পড়ে মহিউদ্দিনের। ২০১৯ সালের ২২ জুলাই রাত সাড়ে ১০টায় সে আমাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে অস্ত্র দেখিয়ে বলে, তুই ওই জমির কাছে যাবি না। গেলে এনকাউন্টারে দিয়ে দেব। মহিউদ্দিনের আক্রমণাত্মক আচরণে আমি ভয় পেয়ে যাই। নিরুপায় হয়ে চিৎকার দিলে লোকজন বাইরে বেরিয়ে এলে আমি বেঁচে যাই। তার কথামতো সম্পত্তি ছেড়ে না দেওয়ায় আমাকে অন্যের পুরনো একটি ইয়াবা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে চালান দিয়ে দেয়।’

হারিছুল বলেন, ‘এ নিয়ে পুলিশ কমিশনার বরাবর গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি।’

বিপুল বিত্তবৈভব
মহিউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায়। তার বাবা আব্দুল মজিদ ছিলেন পুলিশের কনস্টেবল। ‘তদবির করে’ বাবা মজিদ নাকি তার ছেলে মহিউদ্দিনকে কনস্টেবল পদে চাকরি পাইয়ে দেন। সেখান থেকে পদোন্নতি পেতে পেতে মহিউদ্দিন এসআই হন।

অভিযোগ আছে, চাকরিতে যোগদানের পর ক্ষমতার অপব্যবহার ও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন এই মহিউদ্দিন। নগরীর শেরেবাংলা সড়কের বাসিন্দারা বলেন, ২০১৩ সালে ওই এলাকায় ভাড়া বাসায় ওঠেন মহিউদ্দিন। মাত্র ৩ বছরের মাথায় একই এলাকায় ৪৫৯০, ৪৫৯৩, ৪৫৬৯ দাগের ৬.৫০ শতাংশ জমি ৩২ লাখ টাকা দিয়ে কেনেন। সেখানে গড়ে তোলেন ভবন। এ ছাড়া রূপাতলী পল্লীবিদ্যুৎ অফিসের পেছনে আবাসিক এলাকায় ৩৩ শতাংশ, ২৫নং ওয়ার্ডে উকিলবাড়ি সড়কে রফিক মেম্বারের বাড়ির পেছনে ৬ শতাংশ, র‌্যাব-৮-এর সদর দফতর সংলগ্ন রূপাতলী এলাকায় ৩০ শতাংশ, জাগুয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের পেছনের স্কাউট অফিস সংলগ্ন ফরিদ মুন্সীর বালু ভরাট করা প্লটে ১০ শতাংশ এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন খয়রাবাদ সেতুর ঢালে তার ৫০ শতাংশ জমি রয়েছে বলে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশালের পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ এসেছে তার সবকটিরই তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে মহিউদ্দিনকে পুলিশ লাইনসে ক্লোজ করা হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটা অনাকাঙ্খিত ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই ইমেজ সংকট তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হারানো ইমেজ উদ্ধারের একমাত্র পথ। আমরা সেই চেষ্টাই করছি।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু তার অপরাধ তথা আইন বহির্ভূত কাজ করেছে কি না, তা খতিয়ে দেখব। তার অবৈধ সম্পত্তি অর্জনের বিষয়টি দেখবে সরকারের অন্য বিভাগ।’

প্রসঙ্গত, ২৯ ডিসেম্বর রাতে সাগরদী ধান গবেষণা এলাকা থেকে আইনজীবী রেজাউল করিম রেজাকে গ্রেফতার করেন মহিউদ্দিন। এরপর তার কাছে ইনজেকটেবল ড্রাগসহ গাঁজা পাওয়া গেছে উল্লেখ করে মামলা দেওয়া হয়। পরদিন আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয় রেজাউলকে। ১ জানুয়ারি রাতে দুই পায়ের সংযোগস্থল থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। ৩ জানুয়ারি মধ্যরাতে মৃত্যু হয় রেজাউলের। এ ঘটনায় রেজাউলের বাবা বাদী হয়ে গত মঙ্গলবার বরিশাল আদালতে মহিউদ্দিনসহ দুই কনস্টেবলকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

 

 
Electronic Paper